গেল শনিবারে কথা । আমাদের মেহেদীবাগস্থ ওক লাউঞ্জে এমটিও নিয়োগের প্রাথমিক পর্বের ইন্টারভিউ করছিল আমাদের এইচআর ডিপার্টমেন্ট । ৪ হাজার সিভি থেকে অনেক যাচাই-বাছাই করে পিপোল ম্যানেজমেন্টের চৌকস মেম্বার রঞ্জিত, তাসফিয়া আর ফাতেমা একটা শর্ট লিস্ট করে ।ওই প্রার্থীদের সাক্ষাৎকার ছিল ওইদিন । আমাকে তাসফিয়া ওই বাছাই প্রক্রিয়া অবজার্ভ করতে সকাল ১১ টা থেকে লাউঞ্জে থাকতে অনুরোধ করেছিল । আমি সময় মতোই উপস্থিত হই সেখানে ।
তো বাছাইকৃতদের ইন্ট্রোডাকশন পর্ব চলছিল । প্রতি জনের জন্য আলাদা আলাদা নির্ধারিত বিষয়ে তাদেরকে পিচ করতে হচ্ছিল ।
তাকে প্রশ্ন করলাম, জনি জীবনে কি নিয়ে আপনি খুব গর্ব করেন ?
আমাকে অবাক করে দিয়ে সে উত্তর দেয় -আমার বাবাকে নিয়ে !
আমার কৌতুহল বেড়ে যায় ? ফের প্রশ্ন করি, কেন ?
-স্যার, আমার বাবা একজন গাড়ী চালক । জীবনে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর মতো যথেষ্ট টাকা পয়সা আমার বাবার ছিলনা । তারপরও অমানুষিক পরিশ্রম করে, ২ সিফ্টে কাজ করে তিনি আমার ৫০ % টিউশন ফি জোগাড় করেছেন । বাকি টাকা আমি টিউশনি করে আর বিশ্ববিদ্যালয় স্টাইফেন্ড থেকে ম্যানেজ করেছি । আপনিই বলুন স্যার, আমি আমার বাবাকে ছাড়া আর কাকে নিয়ে গর্ব করব ? কী নিয়ে গর্ব করব ?
এর মাঝে আমি কিছু সিভি নাড়াচাড়া করছিলাম । একজনের সিভিতে আমার চোখ আটকে গেল । দেশের অন্যতম সেরা একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইকনমিক্স এন্ড ব্যাঙ্কিং এ স্নাতক এবং স্নাতকত্তোর করা জনি সরকারের অসাধারণ সিজিপি গড়, ৩.৯ আউট অব ৪.০০ ! খুবই গর্ব করার মতো রেজাল্ট ।
জনির সাথে আলাপের বাকী গল্পটা অন্যদিনের জন্য তোলা থাক । আমি বরং দেশের একটি সেরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ করা মেশারফ হোসেনের গল্পটা বলি ।
মোশারফকে প্রথম দেখাতেই ভালো লাগল । কমপ্লিট স্যুট-টাই পরা, কেতাদুরস্থ বেশভুশায় পিচ করা শুরু করল সে । তার পিচিং আমার খুব পছন্দ হলো । চোস্ত ইংরেজীতে দারুণ ছিল তার উপস্থাপনা ।
আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, মোশারফ, আপনি তো ভীষণ স্মার্ট মানুষ, যেমন পোশাকে, তেমনি কথায় । তা আপনার বাবা কি করেন ?
-স্যার, রঙ মিস্ত্রী ! চোখমুখ উজ্জ্বল করে বলল সে ।
আমি কিছুক্ষণ চুপ হয়ে গেলাম । আমাকে স্বাভাবিক করতেই হয়ত মোশারফ বলল, একটা কথা বলতে পারি স্যার ?
-হ্যা হ্যা, বলুন ।
-স্যার, আজকে বাসা থেকে বের হবার সময় বাবা জিজ্ঞেস করছিলেন কই যাচ্ছি ? আমি এখানকার ঠিকানা বলার পর তিনি বললেন, ওহ, হোয়াইট ওক লাউঞ্জ ! ওই লাউঞ্জের রঙের কাজ তো আমি করেছি !
বিশ্বাস করুন কথাগুলো বলার সময় গর্বে মোশারফের ফর্সা মুখ রঙিন হয়ে উঠছিল ।
আমি তার বাবার নাম জিজ্ঞেস করলাম ।
সে নাম বলল । আমি উনাকে চিনতে পারলাম । বললাম, আপনার বাবাকে আমার শ্রদ্ধা জানাবেন ।
এই দুটো ঘটনাই আমার মনে অন্যরকম তোলপাড় তৈরী করে দিয়েছে । কী অবিশ্বাস্য গৌরবে জনি আর মোশারফ তাদের পিতার পরিচয় তুলে ধরল ! এরপর থেকেই আমার মাথা থেকে বিষয়টা আর যাচ্ছেনা ।
আমিতো বহু তরুণের সাথে মিশি । তোমাদেরকেই প্রশ্ন গুলো তাই করি । তোমাদের অনেকেই দেখি বাবার টাকা-পয়সা নিয়ে, দামী বাড়ী-গাড়ী নিয়ে, সামাজিক মর্যাদা নিয়ে, রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে, জাত-পাত নিয়ে গর্ব করো ।
বাবাকে নিয়ে প্রত্যেক সন্তান গর্ব করবে এটাই স্বাভাবিক । বাবাদের অনেক ত্যাগ থাকে সন্তান মানুষ করতে । এখন তোমার বাবা কোন পথে আয় করে তোমাকে বড় করছেন সেটা কী তুমি জানো ?
যে তুমি তোমার বাবার বিত্ত-বৈভব নিয়ে গর্ব করো, তুমি তোমার বাবাকে কখনো জিজ্ঞেস করেছ, তার টাকার উৎস কি ?
দুর্নীতি করে, ঘুষ খেয়ে, জনগনের টাকা মেরে দিয়ে যে টাকার পাহাড় তোমার বাবা তোমাকে দিয়ে যাচ্ছেন সেই সম্পদ নিয়ে কী তুমি সত্যিই গর্ব করো ?
একটু ভাবোতো ! অসৎ পথে উপার্জনকৃত টাকা দিয়ে যে পড়াশোনা তোমাদের করানো হচ্ছে, যে ডিগ্রী তোমরা নিচ্ছ, আদতে তা নিয়ে তোমরা কতটা গর্বিত ?
একটু জনির কথা ভাবো, মোশারফের কথা ভাবো । তারা যতটা গর্বিত তাদের বাবাকে নিয়ে তোমরা কি তাদের মতো বুকে হাত দিয়ে সৎ সাহসে বলতে পারো-আই অ্যাম প্রাইড অব মাই ফাদার !
না, পারার কথা না । বরং লজ্জা পাওয়ার কথা ।
আমি নিজেও জনি আর মোশারফের বাবার মতোই একজন শ্রমিক । হ্যাঁ, হয়তবা প্রতিষ্ঠানের প্রধান শ্রমিক । ওদের মতো আমিও আমার বাবাকে নিয়ে গর্ব করি । আমি চাই আমার সন্তানরা বড় হয়ে যেন আমাকে নিয়ে সত্যিকারের গর্ব করতে পারে । তারা যেন বুক ফুলিয়ে বলতে পারে, আমার বাবা একজন সৎ মানুষ !