মাহমুদ সাহেব গ্রোসারি শপিং করার জন্য তাড়াহুড়া করে একটি সুপারস্টোরে ঢুকার জন্য কিউতে দাঁড়িয়েছেন । কারন আধঘন্টা পরই স্টোর বন্ধ হয়ে যাবে । বিরাট স্টোর তবে সামাজিক সংক্রমন এড়াতে অল্প অল্প করে লোকজন ঢোকানো হচ্ছে । মাহমুদ সাহবে মাস্ক এবং গ্লাবস পরে ঢুকার সময় দায়িত্বরত একজন হ্যান্ড স্যানিটাইজার এগিয়ে দিলেন । তিনি হাত পরিস্কার করতে করতে লক্ষ্য করলেন ৫/৬ বছরের একটি ছোট ছেলে মাস্কটা মুখের উপর তুলে ক্যাশিয়ার এর সংগে একটা খেলনার গাড়ীর দাম দর করছে । ক্যাশিয়ার বারবার ছেলেটার হাতে থাকা কিছু টাকা গুনে মাথা নাড়াচ্ছেন অসন্তুষ্ট ভঙ্গিতে ।
কিছুটা কৌতুহল নিয়ে মাহমুদ সাহেব ক্যাশ কাউন্টারের কাছে গেলেন । তিনি লক্ষ্য করলেন ছোট বাচ্চাটা খুব করে ক্যাশিয়ারকে অনুরোধ করছে গাড়ীটির ব্যাপারে, কিন্তু ক্যাশিয়ার বাচ্চাটির কাছে পর্যাপ্ত টাকা নেই দেখে তাকে বুঝানোর চেষ্টা করছে যে টাকার তুলনায় খেলনার গাড়ীটির দাম অনেক বেশি !
দৃশ্যটা দেখে মাহমুদ সাহেবের বাচ্চাটার জ্ন্য খুব মায়া হলো । তিনি ছেলেটার কাছে এগিয়ে গেলেন , একটু দূরত্বে দাঁড়িয়ে ছেলেটিকে হাই বললেন । তখনও ছেলেটা হাতে খেলনার গাড়ীটা ধরে আছে ।
বাচ্চাটাকে তিনি বললেন, ব্যাটা তুমি খেলনার গাড়ীটা দিয়ে কী করবে ?
প্রশ্নটা শুনে মনে হলো ছেলেটা একটু আশার আলো দেখতে পেল । সে মুহূর্তেই স্বপ্রতিভ হয়ে বলল, আংকেল, এটা আমি আমার দাদাকে উপহার হিসেবে দিতে চাই । আমার বাবা-মা দুজন তো সবসময় খুব ব্যস্ত থাকেন, অফিসের কাজ নিয়ে । দাদা-দাদীই আমার খেলার সঙ্গী ছিলেন । আমার বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলেন । আমাকে প্রায়ই নতুন নতুন খেলনার গাড়ী উপহার দিতেন দাদা । সেই গাড়ী দিয়ে আমার সাথে খেলতেন । আমি আমার দাদীকে গাড়ীটা দিয়ে বলব দাদাকে যখন দেখতে যাবে তখন যেন এটা দাদাকে আমার পক্ষ থেকে উপহার হিসেব দেয় । কথাটা বলার সময় ছেলেটার চোখ ছলছল করছিল ।
ছেলেটা আরও বলল, আমার দাদা আল্লাহর কাছে চলে গেছেন । বাবা বলেছেন দাদীও খুব তাড়াতাড়ি আমার দাদাকে দেখতে আল্লাহর কাছে চলে যাবেন । তাই আমি আমার বাবা-মাকে বলেছি, উপহারটি নিয়ে আসা পর্যন্ত দাদীকে অনুরোধ করতে যেন একটু অপেক্ষা করে আমার জন্য
-তুমি একা এসেছ ? না, কেউ তোমাকে নিয়ে এসেছে ব্যাটা ? মাহমুদ সাহেব কৌতুহলী ভঙ্গিতে জানতে চান ।
– ড্রাইভার আংকেল নিয়ে এসেছেন । সে সুপার মলের এক কর্নারে দাঁড়িয়ে থাকা একজন মাঝ বয়সি লোকের দিকে আঙ্গুল তুলে দেখাল ।
ছেলেটার কথা শুনে মাহমুদ সাহেবের বুকটা হাহাকার করে উঠল । কিছু সময়ের জন্য তিনি দমবন্ধ দমবন্ধ ভাব অনুভব করলেন । নিজেকে সামলে তিনি তার পকেটে হাত ঢুকিয়ে কিছু টাকা মুঠোয় পুরে বললেন , ব্যাটা আমার মনে হয় ক্যাশিয়ার তোমার টাকা গুনতে ভুল করেছে । তোমার টাকা গুলো আমার হাতে দাও, আমি গুনে দিই ।
ছেলেটি হাসিমুখে তার টাকা গুলো মাহমুদ সাহেবের হাতে তুলে দিলো ।
মাহমুদ সাহেবে এবার গুনতে শুরু করলেন । গোনা শেষে বললেন, আরে, এখানে তো অনেক টাকা ! ক্যাশিয়ার তো ভুল গুনেছে । আমি নিশ্চিত এ টাকা দিয়ে তুমি অবশ্যই গাড়ীটি কিনতে পারবে ।
ছেলেটা চোখ বড় বড় করে মাহমুদ সাহেবের হাত থেকে টাকা গুলো নিয়ে পুনরায় গুনতে শুরু করলো । এবং এবার সে অবাক হয়ে বলল ,আংকেল এখানে তো অনেক টাকা । আমি ক্যাশিয়ার আংকেলকে বলছিলাম , আরেকবার গুনে দেখতে । উনি দেখেননি । এখন তো দেখছি আমি আমার দাদার জন্য গাড়ী কিনে দাদীর জন্য একটা সাদা গোলাপও কিনতে পারব । সাদা গোলাপ দাদীর খুব পছন্দ ।
সে বলল, জানেন আংকেল, আমি কাল রাতে আল্লাহকে বলেছি , আমাকে যেন আমার দাদার জন্য গাড়ী কিনার মতো টাকার ব্যবস্থা করে দেয় । কিন্তু ভয়ে আমি আল্লাহকে আমার দ্বিতীয় ইচ্ছার কথা বলিনি যে আমি দাদীকে একটা সাদা গোলাপ দিতে চাই । বাট গড ইজ সো কাইন্ড ! উনি আমাকে গাড়ী কেনার পর সাদা গোলাপ কেনার ব্যবস্থাও করে দিলেন । তারপর ছেলেটা পকেট থেকে তার একটা ছোট ছবি বের করে মাহমুদ সাহেবকে দেখিয়ে বলল, আংকেল আমি এ ছবিটাও আমার দাদীর সাথে দিয়ে দেব । দাদা আর দাদী যেন আমাকে ভুলে না যায় !
ঠিক দুদিন পর মাহমুদ সাহেব সকালে অনলাইন পোর্টালে একটা নিউজ পড়লেন-করোনা ভাইরাস বৃদ্ধ স্বামীর পর এবার কেড়ে নিল তার স্ত্রীর জীবন !
আক্রান্ত হবার পর কোথাও কোনো হসপিটালে জায়গা পাচ্ছিলেন না ৭০ বছর বয়স্ক বৃদ্ধ । প্রচন্ড শ্বাসকষ্টে না পাচ্ছিলেন কোনো ভেনটিলেটর সাপোর্ট । বৃদ্ধার ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে । গতরাতে অবস্থার অবনতি হলে শ্বাসকষ্ট যখন তীব্র হয় তখন এক সিলিন্ডার অক্সিজেন এর জন্য পুরো শহর ঘুরে কোথাও এক বোতল অক্সিজেন মিলেনি । অবশেষে পেনিক থেকে হার্ট এটাকে মারা যান বৃদ্ধা ।
মাহমুদ সাহেব বুঝতে পারলেন ঘটনার বৃদ্ধ এবং বৃদ্ধা সেদিনের সেই ছেলেটির দাদা আর দাদী । তিনি ঠিকানা জোগাড় করে ছেলেটির বাসায় যখন গেলেন তখন ছেলেটির দাদীর বিদায় যাত্রার প্রস্তুতি চলছিল । ৪/৫ জন পিপিই পরা লোকজন লাশ দাফনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন । কফিনের ঢাকনা খোলা থাকায় তিনি স্পষ্ট দেখতে পেলেন ছেলেটার দাদীর কাফন মোড়া শরীরের বুকে ছেলেটার ছবি, সাথে সেই খেলনার গাড়ী আর একটি সাদা গোলাপ !
পাঁচ-ছয় বছর বয়সি একটি ছেলে তার খেলার সাথী-দাদা আর দাদীর জন্য সীমাহীন যে ভালোবাসা দেখিয়েছে তা অনুভব করে মাহমুদ সাহেব আনমনা হয়ে গেলেন । তার চোখ ভিজে উঠল জলে । পাছে কেউ দেখে ফেলবে এই সংকোচে তিনি টিস্যু দিয়ে চোখ মুছে সেখান থেকে খুব দ্রুত প্রস্থান করলেন ।