গেল কয়েকদিন থেকে লক্ষ্য করছি প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই আব্বা তার এক বন্ধুকে ফোন করছেন । এবং অনেকটা রুটিন কাজের মতো করেই তিনি এটা করছেন ।
আমি আব্বাকে গতকাল ইফতারের টেবিলে বিষয়টা নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম
-আব্বা প্রতিদিন দেখছি সকালে ঘুম থেকে উঠেই আপনি আংকেল কে ফোন দিচ্ছেন ? ঘটনা কী ?
-ঘটনা কিছু না রে বাবা, তোমার আংকেল তো একা থাকে । এতো বড় বাড়ী, কিন্তু একটা মাত্র প্রাণ । বয়স হয়েছে তো প্রায় আমার কাছাকাছি (৭০) ! অথচ এই বয়সে সন্তানদের থেকে কতদূরে আছে ! মরেটরে পড়ে থাকলে তো কেউ টেরও পাবেনা এই মহামারির সময় ! তাই প্রতিদিন সকালে ফোন করে দেখি যে ঠিকঠাক আছে কিনা !
আব্বার বন্ধু সিলেটে থাকেন । সিলেট উপশহরে দুতলা বাড়ী তার । অবসর প্রাপ্ত সরকারী কর্মকর্তা । বিপত্নীক । আন্টি মারা গেছেন ৫/৬ বছর হয় । আংকেলকে অনেকে বিয়ের পরামর্শ দিলেও তিনি আর বিয়ে করেননি । তার দুই ছেলে বিদেশে পড়াশোনা করে বিদেশেই স্যাটেল করেছে । একজন কানাডায় অন্যজন অস্টেলিয়ায় । আর মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন এক প্রবাসী ডাক্তার এর কাছে , ক্যালিফোর্নিয়ায় থাকেন তারা । আংকেল বছরে তিনবার ছেলে মেয়েদের কাছে ঘুরতে যান । একেকবার গেলে মাস খানেক থাকেন ।
আব্বাকে বলি, আংকেল একবারে ছেলেদের কাছে চলে গেলেই তো পারেন !
-না, সে যাবেনা । আমরা তো কত বলি । কিন্তু সে দেশে থাকবে । তার ধারনা সে বিদেশে চলে গেলে তার সম্পত্তি গুলো লোকজন ভোগ দখল করবে ।
-আংকেল তো বাসায় তার কোনো আত্নীয় স্বজনকে এনে রাখতে পারেন !
-এটাও সে করবেনা ! আমি বলেছি অন্তত একটা ছেলে রাখ, তোর দেখাশোনা করবে, বাজার করে দেবে । ওষুধ এনে দেবে। । কিন্তু না, সে সব নিজে নিজে করতে চায় !
আব্বা বলেন, লক ডাউন শেষ হলে চিন্তা করছে ঢাকা বসুন্ধরায় তিনটা ফ্ল্যাট কিনে ছেলে মেয়েদের গিফ্ট করবে । তা তোমাদের কোনো প্রজেক্ট আছে বসুন্ধরায় ?
-আছে আব্বা । তবে আপনার কী মনে হয় উনার ছেলে মেয়েরা ঐ ফ্ল্যাট গুলোতে এসে কখনো থাকবে ?
-তা মনে হয় থাকবেনা ।
-তাইলে আব্বা আংকেলকে বলেন, ফ্ল্যাট কিনার চিন্তা মাথা থেকে বাদ দিতে ।
-আসলে ওর কাছে অলস টাকা পড়ে আছে সেজন্য আমাকে বলছে তোমার সাথে কথা বলতে ।
-আব্বা, আংকেলের একাউন্টে কত টাকা আছে এটা হয়ত আংকেল জানেন, কিন্তু উনার একাউন্টে কত সময় আছে সেটা কি উনি জানেন ?
আব্বা চুপ হয়ে যান ।
আব্বা, উনি যদি ছেলে মেয়েদের কিছু গিফ্ট করতে চান তবে উনাকে টাইম গিফ্ট করতে বলেন । দুনিয়াতে এর চেয়ে মূল্যবান উপহার আর কিছু নাই । উনাকে বলেন নি:সঙ্গ জীবন ছেড়ে ছেলে মেয়েদের কাছে চলে যেতে ।
কথা প্রসঙ্গে আব্বা বলে উঠেন , দু’তিনদিন আগে লিটুর সাথে (আমার লন্ডন প্রবাসী ছোট ভাই তানজীবের পেট নেইম ) কথা হচ্ছিল । তার সাথেও তোমার আংকেল এর বিষয়ে কথা হচ্ছিল । তো আমি হঠাৎ করে বললাম, রিমন দেশে আছে বলে বেচে গেছি ! নয়তো সিলেটে আমাকেও এরকম নি:সঙ্গ দিন কাটাতে হতো !
লিটু বলল, না আব্বা, আপনাকে কী আমরা একলা একলা থাকতে দিতাম নাকী ? ভাইয়াও যদি বিদেশে থাকতেন; আপনি ছয়মাস ভাইয়ার সাথে, ছয় মাস আমার সাথে থাকতেন !
আব্বা লিটুর কথা শুনে নাকী হেসেছিলেন !
আমি একটু নস্টালজিক হয়ে পড়ি । হ্যাঁ, আমার বাইরে স্যাটেল করার একটা প্ল্যান ছিল বটে । সেটা প্রায় ১৭/১৮ বছর আগের কথা । আমার ক্যারিয়ারের চিন্তা করে আম্মা খুব করে চাইতেন । আমি বরং নানা যু্ক্তি দিয়ে আম্মাকে বুঝিয়ে দেশে থেকে গেছি । আম্মা একসময় আমার সেই সিদ্ধান্ত যে ঠিক ছিল তা বলেছেন । বিশেষ করে আম্মা যখন ক্যান্সার নিয়ে লড়ে যাচ্ছিলেন, আমাকে প্রায়ই কাছে ডেকে মাথায় হাত বুলাতেন । বলতেন, তুই যদি আমার কথা শুনে চলে যেতি, কী হতো আমার !
আম্মা তখন ব্যাংকক হসপিটালে । মাসে ২/৩ বারও যেতে হতো আমাকে । তারপর যখন দেশে আসলেন তখন নিয়মিত ইউনাইটেড এ নিয়ে যাওয়া । আম্মা বারবার বলতেন, তুই না থাকলে কে করত এসব ? আমি আম্মাকে বলতাম, আম্মা, আল্লাহ হচ্ছেন মহাপরিকল্পনাকারী । তিনি যা করেন তা ভালোর জন্যই করেন ।
আম্মা মাথা নাড়তেন ।
আম্মা যখন চলে গেলেন তার ১ বছর আগে থেকেই আমার ছোট ভাইয়ের বৃটিশ নাগরিকত্ব ইস্যুতে পাসপোর্ট ওরা হোল্ড করে রাখে । আম্মা খুব দেখতে চাইতেন লিটুকে । ছটফট করতেন । ভিডিও কলে প্রতিদিন কথা বলতেন । এভাবে একদিন আম্মা চলে গেলেন । লিটুকে শেষ দেখা দেখতে পারলেন না । আমি আম্মার কষ্টটা টের পেতাম ।
আম্মা যেদিন রাতে মারা যান সেদিন সকালে আমি ঢাকা থেকে সিলেটে যাই আম্মাকে ইউনাইটেড থেকে সিলেটের ভালো কোনো হসপিটালে শিফ্ট করার জন্য । ডাক্তার বলে দিয়েছিলেন আম্মার হাতে খুব একটা সময় নেই । আর আম্মাও সিলেট যেতে চাচ্ছিলেন । আমি সিলেট পৌছে ফেরার কোনো ফ্লাইটে টিকিট পাচ্ছিলাম না । আব্বাকে জানাই , আব্বা বলেন না পেলে কাল সকালের ফ্লাইটে আসো । বাসে আসতে যেওনা । অথচ বিকালেই আমার ট্রাভেল এজেন্ট ফোন করে বলে যে রাত ৮টার ফ্লাইটে একটা টিকিট পাওয়া গেছে ! আমি রাত দশটায় হসপিটালে পৌছি। আম্মা আমার হাতের উপর কালেমা পড়তে পড়তে রাত ১টার দিকে চলে যান ।
সকালেই আম্মাকে নিয়ে সিলেটে ফিরি । আমি নিজে কবরে নামিয়েছি আম্মাকে, নিজ হাতে অনন্ত ঘুমের বিছানায় শুইয়েছি ।
আম্মা মারা যাবার তিন মাসের মাথায় বৃটিশ পাসপোর্ট পেয়ে যায় আমার ভাই ! তবে কী এইসব মহান আল্লাহর পরিকল্পনার অংশ ? দুনিয়ায় তিনি মনে হয় মানুষের সব চাওয়া পুরণ করেননা । পরকালের জন্য অনেক কিছুই হয়ত রেখে দেন । এবং আমরা সেই আশা গুলো নিয়ে বেচে থাকি যে এই দুনিয়ায় না হোক অন্য দুনিয়ায় ঠিকই পূরন হবে আশা !
আমি এমনিতেই খুব আবেগপ্রবণ মানুষ ।জীবনে মাথা দিয়ে নয় বরং হৃদয় দিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছি সবসময় । আব্বার সাথে কথা বলতে বলতে কেন জানি মন খারাপ হয়ে উঠে আমার । আংকেল এর জায়গায় নিজেকে ভাবতে থাকি । আমাদেরও তো বয়স বাড়ছে । বেঁচে থাকলে একসময় ওইরকম বয়সে হয়ত যাব । আমার সন্তানরা তখন কোথায় থাকবে ? ওরাতো বিদেশে পড়াশোনার পরিকল্পনা করছে !
আমার আর আব্বার কথাবার্তা পাশে বসে শুনছিল আমার ছেলে তেহজীব । সে আবেগপ্রবণ হয়ে উঠে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ড্যাড ডোন্ট বি আপসেট ! পড়াশোনা শেষ করে আমি ঠিকই তোমাদের কাছে চলে আসব ! আমার মেয়েটাও ভাইকে দেখে আমাকে একই রকম করে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল ।