Author picture

Tanvir Shahriar Rimon

পানিরও ওজন আছে, মাঝে মাঝে কিছু পানি চোখ দিয়ে বেরিয়ে গেলেই ভালো !

রাত আনুমানিক ১২ টা হবে , ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম । আমার স্ত্রী আমাকে সাড়ে তিনটায় অ্যালার্ম দিতে বলে বাথরুম এ ঢুকল , অ্যালার্ম দেয়ার কথা বলেছে কারন বৃহ:বার আমরা নফল রোযা রাখব বলে ঠিক করেছি । আমরা মানে আমি, আমার স্ত্রী, আব্বা, জায়েদা আর রুমি । বাচ্চা দুইটাও রাখতে চেয়েছিল কিন্তু আমরা না করেছি । 

আমি অ্যালার্ম দিয়ে শুয়ে পড়েছি । অপেক্ষা করছি আমার স্ত্রী কখন বের হবে ওয়াশ রুম থেকে । কিছুক্ষন পর বের হয়েই সে বলল, তার খুব শ্বাস কষ্ট হচ্ছে ! ভাবলাম এটা হয়ত মানসিক কোনো চাপের কারণে ওর মনে হচ্ছে, এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে । 

লাইট নিবিয়ে ও বিছানায় ওঠে আসল । কয়েকবার এপাশ ও পাশ করে উঠে বসল । না তার শ্বাস কষ্ট কমছেনা বরং বাড়তে লাগল , সে খুব অস্বস্থি অনুভব করছিল । জোরে জোরে শ্বাস নেয়ার চেষ্টা করছিল । 

আমি খুব ভয় পেয়ে গেলাম, আমার মনে তখন নানা চিন্তা শুরু হয়ে গেছে । আব্বা ১১ টার দিকে শুয়ে পড়েছেন, ডাকব কি ডাকবনা ভেবে পাচ্ছিলামনা । 

আমার খুব আপনজনদের এরকম মুহূর্তে আমি খুব অস্থির হয়ে যাই, আমার মাথা ঠিকঠাক কাজ করেনা ! 

আমার স্ত্রী বলল পানি, পানি খাব 
আমি রীতিমতো দৌঁড়ে ডাইনিং এসে পানি ভরে গ্লাস নিয়ে ছুটলাম বেডরুম এর দিকে । তাড়াহুড়া করতে গিয়ে কিছুটা পানি ফেলে দিলাম । 

সে পানি ঢক ঢক করে শেষ করল । 
-কি, কেমন লাগছে এখন ? 
-মনে হচ্ছে গলার কাছে কিছু একটা আটকে আছে, শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে । 
সে জোরে জোরে আবার হা করে শ্বাস নেয়ার চেষ্টা করল । 
আমাকে বলল, আমার খুব ঘাম হচ্ছে , এসির ঠান্ডাটা বাড়িয়ে দাও । 
আমি এসির টেম্পারেচার ২৩ থেকে ২০ এ নামিয়ে আনলাম । 
এখন কেমন লাগছে জিজ্ঞেস করি ওকে । 
-না ভাল লাগছেনা, শ্বাস আটকে আসতেছে, তুমি আমাকে ট্যারেসে নিয়ে চল । 
আমি ওকে ধরে ধরে খোলা ট্যারেসে নিয়ে এলাম , কিন্তু বাইরে তখন কোনো বাতাস নেই, একদম শুনশান অবস্থা । 
ওখানে বসে সে জোরে জোরে হা করে শ্বাস নিতে চেষ্টা করল…

আমি মনে মনে ভাবতে থাকলাম , এই অবস্থায় ডাক্তার কেউ তো ফোন তুলবেনা । ডাক্তার মিনা আপাকে কী ফোন করব ? নাকী ওকে কোনো হসপিটাল এ নিয়ে যাব ? 

কাছে পিঠে অনেক ক্লিনিক আছে সরকারি হাসপাতাল আছে । 
আমি আমার স্ত্রীকে বললাম, আমার মনে হয় আর দেরি করা ঠিক হবেনা। চলো, হসপিটালে যাই… 
-না না, হসপিটালে যাওয়া লাগবেনা , গেলে তো করোনা রোগী ভেবে তাড়িয়ে দেবে ! 

কি যা তা বলো, করোনা রোগী ভাববে কেন ? তোমার জ্বর নাই, কাশি নাই । অন্য কারণেও তো শ্বাস কষ্ট হতে পারে, নাকী ?  
না পারেনা, এখন সবাই করোনা রোগী …এমনই ভাবনা উনাদের । 

কথা বলতে বলতে সে বলল, আমার বমি বমি লাগছে । আমাকে একটু বাথরুম এ নিয়ে চল । 

বাথরুম এ গিয়ে সে বমি করল…বমি হওয়ায় হয়ত তার ভালোলাগবে । আমি পানি নিয়ে আসলাম । সে আস্তে আস্তে পানিটা খেয়ে বলল, আবার একটু ট্যারেস যাব । 

ওকে ট্যারেসে এ নিয়ে আসলাম । পরিস্কার ঝকঝকে আকাশ । বাতাস খুব একটা নেই । 

তা, এখন কি একটু ভাল লাগছে ? 
সে মাথা ঝাঁকাল 
মিনিট পাঁচেক ওখানে বসে সে আমাকে বলল, একটু সোফাতে বসব । 
পাশেই ফ্যামিলি লিভিং এর সোফাতে এসে সে বসল । বসে সে আনমনে অনেকক্ষন আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল ।তারপর বলল, আমাকে একটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরতো । 

আমি উঠে ট্যারেসের সাথে লাগানো থাই স্লাইডিংটা পুরোপুরি খুলে দিলাম । তারপর পাতলা পর্দাটাও একপাশে টেনে দিলাম যাতে বাতাস ঢুকতে পারে । এতে করে মৃদু বাতাস আসছে মনে হলো । 

আমি ওর পাশে গিয়ে বসলাম, ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম ! 
সে বলল, বিশ্বাস করো, খুব ভয় পাইছিলাম -তোমাদের ছেড়ে যাবার ভয় ! 
কিছুক্ষণের জন্য মনে হচ্ছিল দম মনে হয় ফুরিয়ে আসছে …! বাচ্চা দুটোর কথা বেশি বেশি ভাবছিলাম…দেখো, কি অনিশ্চিত পৃথিবী, মিনিটের ব্যবধানে সুস্থ মানুষ অসুস্থ হয়ে গেলাম …। 

এখন কেমন লাগছে তোমার ? 
কিছুটা ভাল লাগছে, শ্বাস নিতে পারছি…। 
শ্বাস নাও , প্রাণ খুলে শ্বাস নাও-তুমিইতো আমাদের শ্বাস ! 

চাঁদের স্পষ্ট আলোয় আমি দেখতে পাই , ওর চোখ বেয়ে পানি পড়ছে…
ওই পানি আমি মুছতে চেষ্টা করিনা । পানিরওতো একটা ওজন আছে ! মাঝে মাঝে কিছু পানি চোখ দিয়ে বেরিয়ে গেলেই ভালো । 

কেন জানি আমার চোখও ঝাপসা হয়ে আসে, তবু আমি শক্ত করে জড়িয়ে রাখি আমার স্ত্রীকে , আমার নি:শ্বাসকে !

-তানভীর শাহরিয়ার রিমন

Subscription

Leave a Reply