Author picture

Tanvir Shahriar Rimon

যখন কষ্টে থাকা মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে পারবে তখনই তুমি প্রকৃত বিজয়ী হবে !

সকালে নাস্তার টেবিলে বসে ফেসবুক পোস্ট পড়েই কন্ট্রাক্ট নাম্বারে ফোন দিই

-ভাই, আপনাদের কী AB+ ব্লাড লাগবে ?

-জি ভাই লাগবে, ৪ ব্যাগ লাগবে ।

-ব্লাড কি ম্যানেজ হয়েছে ?

-না এখনো হয়নাই । তবে তিনজন আসবে বলছে । আপনি আসলে আল্লাহর রহমতে এই সপ্তাহ চলে যাবে ।

-এই সপ্তাহ চলে যাবে মানে ? প্রতি সপ্তাহে রক্ত লাগে নাকী ?

-জি লাগে । ব্লাড ক্যান্সার পেশেন্ট । রক্তে প্লাটিলাট ধরে রাখতে পারেনা ।

-রোগী আপনার কি হয় ?

-জি , আমার ভাগিনা । ১২ বছর বয়স । ৭ বছর থেকেই অসুস্থ ।

কথা বলতে বলতে আমার মন খারাপ হয়ে গেল । আমার ছেলের বয়সি একটা ছেলে । আমি সিদ্ধান্ত নিই যেভাবেই হোক, যখনই হোক আমি রক্ত দিতে যাব ।

আমি তাকে আশ্বস্ত করে বললাম, চিন্তা করবেননা । আমি আসব । তা কয়টার দিকে আসতে হবে ।

-ভাই, ১২.৩০ এর দিকে আসলে হবে ।

১০ টায় অফিসে এসে কিছু জরুরি মিটিং শেষ করে আমার কোর্ডিনেটর লুইসেলকে বললাম, সাড়ে বারটায় একটু আন্দরকিল্লা রেডক্রিসেন্ট ব্লাড ব্যাংকে যেতে হবে । আমার ১২ টার পরের মিটিং গুলো দুপুরে ৩টার পরে এডজাস্ট করে নাও ।

লুইসেল মাথা নাড়ল । তারপর বলল, স্যার, ব্লাড ব্যাংকে যাবেন কী রক্ত দিতে ?

-হ্যা রক্ত দিতে ।

-রোগী কি স্যার আপনার আত্নীয় ?

-না, সকালে ফেসবুকে পড়লাম । ক্যান্সার পেশেন্ট । বাচ্চা ছেলে ।

-স্যার, আমি আপনার সাথে যেতে চাই ।

-তোমার ব্লাড গ্রুপ কী ?

-স্যার আপনার আর আমার একই গ্রুপ । AB+

-তাই ? দারুণ তো । কখনোতো বলনি আমাকে । তা শেষ কবে ব্লাড দিয়েছে ?

-এই তো স্যার বছর খানেক আগে ।

-নিয়মিত দাওনা কেন ?

-ব্যাটে বলে হয়না স্যার ।

-লুইসেল, ব্যাট আর বলের কোনো দোষ নাই । পুরোটা ইচ্ছা শক্তির ব্যাপার !

লুইসেলকে নিয়ে আমি ঠিক সময়মত পৌছে গেলাম ব্লাড ব্যাংকে । সেখানে গিয়ে রোগীর মামার সাথে দেখা হলো । তিনি আমাকে দেখে খুশি হলেন । ডোনার চারজনের মাঝে কেবল আমিই তখন পৌঁছেছি ।

আমি উনাকে তাড়া দিয়ে বললাম, একটু জলদি করতে হবে । অফিসের ম্যালা কাজ ফেলে এসেছি ।

উনি মোবাইলে বাকি ডোনারদের সাথে যোগাযোগ করলেন । তারপর বললেন, এই তো দশ মিনিটের মাঝে চলে আসবে ।

তাকে বললাম, আমাকে পেশেন্টের কাছে নিয়ে চলেন । তিনি আমাকে ভেতরে নিয়ে গেলেন । হাত দিয়ে ইশারা করে দেখালেন তার ভাগ্নেকে ।

আমি দেখলাম একটা তাজা প্রাণ কীরকম ফ্যাকাশ হয়ে গেছে রক্তের অভাবে ।

-বাবা, কী নাম তোমার ?

সে কোনো উত্তর দেয়না । ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে ।

পাশ থেকে মামা বলেন, রাফি, আংকেলকে নাম বলো ?

তবু সে চুপ ।

রাফির মামা বলেন, গলা দিয়ে কথা বলতে কষ্ট হয় । আর বোনম্যারু ট্রান্সপ্লান্ট এর কথা শুনে ভয় পাইছে । চিৎকার করে কান্নাকাটি করছে ।

-তা কোথায় দেখিয়েছেন ওকে । ডাক্তার কি বলেছেন ?

-পার্কভিউয়ের রেজাউল সাহেব দেখতেন । তবে এখন তিনি বলছেন রাফিকে চেন্নাই নিয়ে যেতে । আমরা গিয়েছি । বোনম্যারু ট্রান্সপ্লান্ট এর খরচ সেখানে ৫০ লাখ টাকা । আমরা গরিব মানুষ । এতো টাকা কই পাব । তাই আশা ছেড়ে দিছি । রক্ত দিয়ে দিয়ে যে কদিন বাঁচে…বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি । 

আমি তার কাঁধে হাত রেখে বলি, ভাই আল্লাহর রহমতে সে সুস্থ হবে । আপনারা চেষ্টা চালিয়ে যান ।

-ভাই, এত টাকা কই পাব ?

-১৭ কোটি মানুষের দেশে জনপ্রতি এক টাকা করে দিলে ১৭ কোটি টাকা হয় ভাই ! দেশের মানুষের মন কত বিশাল ! তারা এতো সহজে রাফিকে মরতে দেবেনা ।

আমার কথায় তিনি বিশ্বাস করেছেন বলে মনে হলোনা । এর মাঝে দুজন ডোনার উপস্থিত হলেন । একসাথে চারজনের ব্লাড নিতে হবে। । তারপর চারজনের ব্লাড থেকে প্লাটিলেট বানিয়ে সেটা রাতে ইনজেক্ট করা হবে ।

এদিকে বাকি একজন ডোনারের আসার খবর নেই ।

হঠাৎ করে লুইসেল বলল, আমিও রক্ত দিব ! আমারও একই ব্লাড গ্রুপ ।

রাফির মামা যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলেন । আমরা চারজন রক্ত দিলাম । রক্ত দেয়ার পর রাফির সাথে ছবি তুললাম । ওকে হাঁসানোর চেষ্টা করলাম । কিন্তু পারলাম না । মিনিট দশেক পর ডাবের পানি খেয়ে বিদায় নিতে রাফির কাছ গিয়ে ওর মাথায় হাত রেখে বললাম, বাবা তুমি ভালো হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ । আমরা সবাই তোমার জন্য দোয়া করব ।

আমি চলে যেতে পা বাড়িয়েছি এমন সময় রাফি আমার হাত টেনে ধরল । তারপর মুখ আলো করে হাসার চেষ্টা করল । আমি আবারো ওকে কাছে টেনে নিলাম । মাথায় হাত বুলিয়ে বাইরে বের হয়ে আসলাম ।

লুইসেল, কেমন লাগছে তোমার ?

-স্যার, রক্ত দিতে পেরে অসাধারন লাগছে । খুব ভাল্লাগছে । তবে ছেলেটার জন্য কষ্টও হচ্ছে ।

-ওর মুখে হাসি দেখেছ ?

-স্যার দেখছি । কী নিষ্পাপ হাসি !

-লুইসেল, আমরা গতকাল বিজয় দিবস পালন করেছি তাইনা ।

-জি স্যার । আমি লাল পাঞ্জাবি পরছি স্যার । সাথে সবুজের  কাজ ।

শোনো, শত্রুকে যুদ্ধের ময়দানে হারানোই কেবল বিজয় নয় । জাতীয় পতাকার রঙে কাপড় পরার নামই বিজয় নয় । তুমি যখন কোনো কষ্টে থাকা মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে পারবে প্রকৃতপক্ষে তখনই তুমি বিজয়ী হবে ।

লুইসেল আমাকে ভিক্টরি সাইন দেখাল । আমিও দেখালাম । আকাশের দিকে তাকিয়ে বিশ্বজাহানের মালিকের কাছে ফরিয়াদ করলাম, হে খোদা, রাফিকে অসময়ে নিয়ে যেওনা । রোজ কত মিরাকেল ঘটে যায়, রাফির জন্য তুমি কোনো মিরাকেল করে দেখাও, খোদা !

পুনশ্চ: AB+ যাদের রক্তের গ্রুপ তারা চাইলে রাফিকে ব্লাড দিয়ে তার বেঁচে থাকার যু্দ্ধে সহায়তা করতে পারেন । যোগাযোগ: রাফির মামা : আজাদ -01631948560

Subscription

Leave a Reply