বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উত্তরণের দারুন সম্ভাবনা নিয়ে সম্প্রতি ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ড (আইএমএফ) তাদের অর্থনৈতিক আউটলোক ডাটাবেইসে অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক তথ্য প্রকাশ করেছে । তারা প্রত্যাশা করছে ২০২৪-২৫ আর্থিক বছরে বাংলাদেশ জিডিপি সাইজ হবে অর্ধ ট্রিলিয়ন ডলার । যা ছাড়িয়ে যাবে সিঙ্গাপুর, ডেনমার্ক, হংকং, আরবআমিরাতের মতো দেশকে ।
প্রত্যাশা অনুযায়ী ঐ সময়ে বাংলাদেশ এর অর্থনীতির আঁকার হবে ৫১৬ বিলিয়ন ডলার যখন একই সময়ে সিঙ্গাপুরের সাইজ হবে ৪৬১ বিলিয়ন ডলার, হংকং এর ৪৫২ বিলিয়ন ডলার, আরবআমিরাতের ৪৮০ বিলিয়ন ডলার, নরওয়ের ৪৯৭ বিলিয়ন ডলার এবং ফিলিপিন ৫০৬ বিলিয়ন ডলার ।
আমি বলছিনা যে অর্থনীতির আঁকার বৃদ্ধির ফলেই আমরা সিঙ্গাপুর এর মতো ধনী রাষ্ট্র হয়ে যাব ।
আমাদের দেশে যেহেতু ১৭০ মিলিয়ন মানুষের বাস তাই কেবল জিডিপি বৃদ্ধি দিয়েই আমরা ডেনমার্ক, সিঙ্গাপুর, হংকং, আরব আমিরাত থেকে ধনী রাষ্ট্র বা উন্নত রাষ্ট্র হয়ে যাবনা । অর্থনীতির অনেক অংক আছে, সেটাও বুঝতে হবে । ধরেন আমাদের জিডিপি ৫০০ বিলিয়ন হলো, তখন আমাদের মাথা পিছু আয় হবে প্রায় ৩হাজার ডলার । অথচ আমাদের চেয়ে কম জিডিপি নিয়েও সিঙ্গাপুরের মাথা পিছু আয় হবে তখন ৭৯ হাজার ডলার ! আরো একটু ভেঙ্গে বলি, এই দক্ষিন এশিয়ার সবচেয়ে বড় জিডিপি হলো ভারতের । ২০২৫ এ ভারতের জিডিপি হবে ৪ ট্রিলিয়ন ডলার কিন্তু তাদের মাথা পিছু আয় হবে আমাদের চেয়ে কম, ২হাজার ৮শত ডলার । কারন ভারতের জনসংখ্যা প্রায় ১৫০ কোটি !
কাজেই আমাদের জিডিপি যেদিন ৫০০ বিলিয়ন হবে সেদিনই আমরা ধনী রাষ্ট্র হয়ে যাচ্ছিনা যতক্ষননা আমরা নতুন নতুন বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান তৈরী করতে পারছি । যখন অধিকাংশ জনগনের হাত কর্মীর হাতে রুপ নেবে, কন্ট্রিবিউটরের হাতে রুপ নেবে, তখনই মাথা পিছু আয় বাড়বে । আমরা ধীরে ধীরে উন্নত রাষ্ট্রের পথে পা বাড়াব ।
এখন অন্য প্রসঙ্গে আসি । বাংলাদেশ এর বর্তমান জিডিপি সাইজ ৩৫৫ বিলিয়ন ডলার, এবং মাথাপিছু আয় সম্প্রতি ২৫০০ ডলার ছুয়েছে । ভিয়েতনামের জিডিপি সাইজ ২৯০ বিলিয়ন ডলার এবং তাদের মাথাপিছু আয় ৩৬০৯ ডলার । একটা বিষয় খেয়াল করা দরকার যে ভিয়েতনামের জিডিপি সাইজ আর তাদের রপ্তানী আয় প্রায় সমান । কিন্ত বাংলাদেশ এর জিডিপি কেবল রপ্তানীর উপর নির্ভর নয় । আমাদের যে প্রায় সাড়ে তিনশত বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি তার ১৪ শতাংশ আসে কৃষি থেকে । সেবা, রেমিটেন্স এবং এসএমই খাত মিলে ৫২ শতাংশ অবদান । আর শিল্প খাতের অবদান ৩৩ শতাংশ । এই শিল্প খাতের মাঝে রপ্তানী নির্ভর তৈরী পোশাক শিল্প ১২ শতাংশ অবদান রাখছে । তাহলে খেয়াল করে দেখুন জিডিপির একটা বড় অংশ আভ্যন্তরিণ দেশীয় শিল্পের উপর নির্ভর করছে । আর এখানে নির্মাণ ও আবাসন শিল্পের অবদান ৮ শতাংশ । যেখানে জড়িত প্রায় ৪০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান ।
ধরেন ২০৩০ এ প্রত্যাশা অনুযায়ী যদি বাংলাদেশ এর জিডিপি বৃদ্ধি ঘটে তাহলে এর সাইজ হবে ১ ট্রিলিয়ন ডলার । তাহলে নির্মাণ এবং আবাসন খাতের অবদান যদি তখনো ৮ শতাংশ থাকে তাহলে ৭০/৮০ বিলিয়ন ডলারের একটা মার্কেট দাঁড়াবে তখন, ভাবা যায় ?
ভাবা না গেলেও এখন আমাদেরকে ভাবতে হচ্ছে । আমরা তো বেসরকারি উদ্যেগে দীর্ঘদিন থেকে মানুষের আবাসনের ব্যবস্থা করার চেষ্টা করছি । আমরা চেষ্টা করছি এটাকে টেকসই করতে । সেজন্য আমাদের আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাব থেকে নানা সময় নানা রকম প্রস্তাবনাও দেয়া হয়েছে । তার খুব অল্প সংখ্যক প্রস্তাবনাই আলোর মুখ দেখেছে । পিপিপি মডেলে কাজ করতে আমরা আমাদের আগ্রহের কথা বারবার জানিয়েছি । অথচ কেন জানি এসব খুব একটা গতি পায়নি । আমাদের দেশে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১২৬৫ জন লোক বসবাস করে কাজেই জমির অপ্রতুলতা এখানে রয়েছে । আর এ কারনে মধ্যবিত্তের আবাসন সংকটের কোনো সুরাহা হয়নি ।
এর মাঝে গেল এক বছর ধরে চলছে নির্মাণ সামগ্রীর অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি । এখন এই খাতকে কী করে টেকসই করবেন ? এটাতো ট্রেডিং নয় । আমরা আজ জমি নিয়ে কালই বিল্ডিং বানিয়ে ফেলতে পারিনা । একটা ভবন নির্মাণ করতে ২/৩/৪ বছর সময় লাগে । অথচ এক বছরের মধ্যেই যদি কাঁচামালের ২৫ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধি ঘটে তাহলে কী করে প্রতিষ্ঠানগুলো টিকে থাকবে আর কী করে টেকসই হবে এই খাত ! একটা পরিসংখ্যান দিলে বুঝবেন কতটা কঠিন সময় পার করছি আমরা । গেল ১ বছরে ভবণ নির্মাণের প্রধান কাঁচামাল রডের মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে ৩৬ শতাংশ । এক বছর আগে যে রডের দাম ছিল টন প্রতি ৫৮ হাজার টাকা সেই একই রডের বর্তমান বাজার দর ৮০ হাজার টাকা । যেভাবে দাম বাড়ছে তাতে করে আমরা আশংকা করছি এই মূল্য হয়ত টন প্রতি ৯০ হাজারে গিয়ে ঠেকবে । এবার অন্য কাঁচামালের হিসাব দিই । সিমেন্টের দাম বেড়েছে ১০ শতাংশ, ইটের ১২ শতাংশ, পাথরের ৮ শতাংশ, বালুর ৮ শতাংশ. ইলেকট্রিক ক্যাবলের ৫৩ শতাংশ, হোলোবক্স এর ৯৩ শতাংশ, ইউপিভিসি পাইপের ২৬ শতাংশ, রঙের ১১ শতাংশ । এই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারনে এতো অমিত সম্ভাবনাময় একটা খাত কতটা চ্যালেঞ্জে পড়েছে আশা করি সবাই বুঝতে পারছেন ।
পুরো পরিস্থিতিটা এমন যে এখন সমন্বিত উদ্যেগ ছাড়া এই অবস্থা থেকে পরিত্রানের কোনো পথ আমরা আদৌ দেখছিনা । সরকারের সহযোগিতার পাশাপাশি, অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান, ভ্যালুচেইন পার্টনার, ভুমিমালিক, বিনিয়োগকারী সকলের অংশগ্রহন মূলক ভূমিকা হয়ত আলো দেখাতে পারে এই খাতকে ।
আমাদের জিডিপি বাড়ছে । এই জিডিপি বৃদ্ধি কোনো অংশেই ফেলনা না । আবারো বলছি, আমাদের জিডিপি শুধু রপ্তানী নির্ভর না । এখানে দেশীয় শিল্পের বড় স্টেক আছে, আছে কৃষির বিশাল অবদান সেই সাথে রেমিটেন্স যোদ্ধাদের ঘাম মাখানো অংশগ্রহণ । তাই এই জিডিপির মূল্য আছে । আমাদের দরকার প্রচুর কর্মসংস্থান । দরকার ইজ অব বিজনেস । দরকার সর্বক্ষেত্রে নীতি এবং সততা । তাহলে বাংলাদেশকে কেউ আটকাতে পারবেনা ।
বাংলাদেশ গৌরবে এগিয়ে যাক ।