জাপানের ওকিনাওয়া দ্বীপের মানুষটার নাম ওয়াল্টার ব্রেউয়িং । তার বয়স কত হতে পারে ? ১২২ ? ধরে নিন তাই । দেখতে অবশ্য ৬০ বছরের বেশি মনে হবেনা । অন্তত কথা বার্তায় তাই মনে হবে । আমাকে তিনি হাসি দিয়ে আলিঙ্গন করে তার বসার ঘরে নিয়ে গেলেন । বসতে বলতেই আমি সোফাতে গা এলিয়ে বসে পড়লাম, চীর তরুণের সামনে ।
-তা, কী খাবে, রিমন ? আমাকে হোয়াইট টির পেয়ালা এগিয়ে দিয়ে বললেন তিনি ।
-সুশি ! চোখ বন্ধ করে উত্তর দিলাম ।
আমার কাপে ততক্ষণে চা শেষ হয়ে গেছে । তিনি তার স্বচ্ছ কেতলী থেকে আমার শূন্য কাপে ঢালা শুরু করলেন চা । আরাম করে বসে হোয়াইট টি খাচ্ছি । আড্ডা পুরাই জমে উঠেছে ততক্ষণে !
বৎস, আমি জানি, তুমি কী শুনতে চাও, ছোট চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন তিনি, যেনবা তিনি আমার মনের সব কথা পড়ে ফেলেছেন !
শোনো, মন আর শরীর দুটোকেই যত দিন পারো ব্যস্ত রাখো !
আমি প্রশ্রয় পেয়ে তাকে এবার জিজ্ঞেস করি, এই যে এত বছর ধরে তারুণ্য ধরে রেখেছেন, মরতে যে হবে একদিন, ভয় কাজ করেনা ?
-ভয় ? ভয় কেন কাজ করবে ? এই মৃত্যুর জ্ন্যই তো পৃথিবীতে আসা । এরচেয়ে অবধারিত আর কিছু নাই, নাকী ? স্মিত হেসে উত্তর দেন ওয়াল্টার ।
-আচ্ছা, ধরলাম আপনি মৃত্যুকে ভয় পাননা ! কিন্তু এই যে এই দ্বীপের সবাই, আপনার মতোই কী করে এত বছর ধরে তরুণ আছেন ? এতো সুখে আছেন ! আনন্দে আছেন !
শোনো, ইয়াং ম্যান -“ইকিগাই” ! আমাদের সবার জীবনে আছে ইকিগাই । বেঁচে থাকার কারণ আছে জীবনে ।
“ইকিগাই” সাম্প্রতিক সময়ে খুব আলোচিত একটি বই । রাইটার জুটি -হেক্টর গারসিয়া আর ফ্রান্সেস মিরালেস রীতিমতো গবেষনা করে জাপানীদের সুখী এবং দীর্ঘ জীবনের রহস্য বের করেছেন ।
ইকি জাপানি শব্দ, যার অর্থ জীবন আর গাই শব্দের অর্থ হলো কারণ (মানে) ।
ইকিগাই পড়তে পড়তে আমার কাছে সত্যি সত্যি মনে হচ্ছিল যে জাপানের ওকিনাওয়া দ্বীপে আমি ওই শতায়ু পাওয়া মানুষগুলোর সাথেই কথা বলছি ।
আমি ওয়াল্টার ব্রেউয়িংকে ফের জিজ্ঞেস করলাম, আপনাদের বেঁচে থাকার কারণ আছে ! আমাদের কী নেই ?
তিনি উত্তর দিলেননা । বললেন, তুমি একটু গভীরে গিয়ে ভাবো ।
আসলেই তো, গভীরে ভাববার বিষয় এটা ।
আমরা কেন অল্পতে বুড়িয়ে যাই ? আর ওরা কেন ৯০ বছরেও তরুণ থাকে ? একেকজন একেক কথা বলবেন । কেউ বলবেন স্ট্রেসের কথা । নিদারুণ মানসিক চাপ মানুষকে নিরন্তর ভোগায় এবং অল্পতেই বুড়ো বানিয়ে ছাড়ে । এমনকি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট করে দেয় । স্মৃতি শক্তি কমে যায়, ক্রোধ এর উপর নিয়ন্ত্রন থাকেনা, ইনসমনিয়া দেখা দেয় !
তাহলে কী করে এই চাপ থেকে বের হবেন ? উত্তর, ইকিগাই । জীবনে “রিজন অব লিভিং” খুঁজে পেতে চেষ্টা শুরু করেন । মাইন্ডফুলনেস বা মননশীলতার চর্চা শুরু করেন । এটার শুরুটা করতে হবে নিজেকে গুরুত্ব দেয়া থেকে । এবং সেটা করার জন্য আপনাকে মেডিটেশন বা ধ্যান করতে হবে । বিশ্বাস হচ্ছেনা ? একবার করেই দেখুন । ফলাফল পাবেন নিশ্চিত । আমি অবশ্য এটা নামাজে করি । বিশেষ করে রাতের নামাজে যখন পুরো পৃথিবী ঘুমিয়ে থাকে তখন । সাড়ে চারটায় বেড থেকে উঠে পড়ি । এবং যখন নামাজে দাঁড়াই তখনই ধ্যানটা আপনা আপনি হয়ে যায় ।
বিশ্বাস করুন, এই ধ্যান আপনার মধ্যে যত নেগেটিভ ইমোশন আছে সেটাকে ফিল্টার করবে । আপনার হিংসা, রাগ, অহংকার, আমিত্ব কমাবে । এগুলোই তো আমাদেরকে মাইন্ডফুলনেস অর্জন করতে বাঁধা দেয় । সবসময় একটা অস্থিরতার মাঝে বেধে রাখে আমাদের । এই বাঁধন খুলতে হবে । আলগা করতে হবে গেরো ।
মনে রাখবেন, ইকিগাই একটা কিক । সেই কিক আপনাকে বদলে দেবে । আপনাকে পুরো নতুন মানুষ হিসাবে তৈরী করবে, বিলিভ মি !
এই প্রসেস অর্জনের আমি কিছু সিক্রেট শেয়ার করছি-
- পজিটিভ ফ্রেইম অব মাইন্ড ধারণ করতে হবে
- সবসময় একটিভ থাকতে হবে, জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কাজ করে যাওয়া । নো রিটায়ার বিফোর দ্যা লাস্ট ব্রেথ !
- ধীরস্থির হতে হবে ।
- পরিমিত খেতে হবে । পেটের ৮০ শতাংশের বেশি খাওয়া যাবেনা ।
- নিজের চারপাশে ভালো বন্ধু রাখতে হবে
- প্রচুর হাসতে হবে
- শরীর চর্চা, সাঁতার কাটা, হাঁটার অভ্যাস করতে হবে
- প্রকৃতির সাথে সময় কাটাতে হবে
- নিজের পিতামাতা, আত্নীয় স্বজন, পরিবার পরিজন, বন্ধু বান্ধব এমনকি প্রকৃতির প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধ থাকতে হবে ।
- বর্তমান নিয়ে বাঁচতে হবে । অতীত আর ভবিষ্যত নিয়ে নেগেটিভ ভাবনা ছেড়ে দিতে হবে ।
- এবং নিজের ইকিগাই খুঁজে বের করতে হবে । অর্থ্যাৎ নিজের জীবনের মানে খুঁজে বের করতে হবে ।
ইকিগাই খুঁজতে হলে জীবনের ফ্লো (যে কাজে আপনি আনন্দ পান) খুঁজে বের করতে হবে । আপনি কিসে ফ্লো অনুভব করেন ? একটু ভাবুন । আপনি যে কাজটা করছেন তাতে কী আপনি আনন্দ পান ? নাকী মাস শেষে বেতন পাওয়ার জন্য দিনের পর দিন নিরানন্দে কাজটি করে যাচ্ছেন, ভাবুন প্লিজ ।
আমি আমার ক্যারিয়ারের শুরুতে মাল্টিন্যাশনাল ব্যাংকে কাজ করার সুযোগ পেয়েও কেন জয়েন করিনি, জানেন ? ফ্লো খুঁজে পাইনি, যেটা আমি আমার রিয়েলটর পেশায় প্রথম বছরেই খুঁজে পেয়েছিলাম । আমি এখনো আমার সহকর্মীদের বলি, ডোন্ট কাম টু অফিস টু ওয়ার্ক, কাম টু কনট্রিবিউট । তারা কখন কনট্রিবিউট করতে পারবে? যখন তারা কাজে ফ্লো পাবে, মানে আনন্দ পাবে ।
দারুণ ডিজাইনের নিত্য নতুন বিল্ডিং বানানোর পাশাপাশি আরো নানা কাজে আমি ফ্লো পাই । যেমন ধরেন আমি লিখালিখি করি, এটা আমাকে ফ্লো দেয় । আমি পাবলিক স্পিকিং করি, এটাও । যখন ব্লাড ডোনেট করি, কিংবা সমাজ সেবা মূলক কোনো কাজ করি সেটাও । বন্ধুদের সাথে যখন আড্ডা দিই তখনো । এই ফ্লোতে থাকাটা খুব দরকারী ।
বিলগেটস নিজের প্লেট নিজেই পরিস্কার করেন, এটা নাকী তাকে আনন্দ দেয় । ঠিক তেমনি আমি আমার অফিসে নিজ হাতে কফি বানাই । এবং সেটা আমার ক্লায়েন্টদের সার্ভ করি । এটা আমাকে ফ্লো দেয় । আমি চেষ্টা করি নানা রকমের কফি বানাতে এবং চেষ্টা করি এটা যেন ভালো হয় । এইসব কিছু একঘেয়েমি দূর করে । কাজে আনন্দ বাড়ায় ।
আমাদের চট্টগ্রাম ক্লাবের জিমে সাপোর্ট স্টাফ হিসাবে কাজ করেন ইউসুফ ভাই । প্রায় ৩০ বছর ধরে তিনি একই কাজ করছেন । কিন্তু তিনি ফ্লোর মাঝে আছেন । তিনি সবার সাথে কথা বলেন, গল্প করেন, পানি এগিয়ে দেন, জিম কিট বের করে দেন, স্টিম বাথ রেডি করে সেখানে ম্যানথল দিয়ে দেন যাতে মেম্বাররা খুশি হয় । এই কাজটা তিনি সবার জন্য করেন । নির্দিষ্ট কারো জন্য না । তার বয়স ৫৩ বছর হবে । তার মাথার চুল পাকেনি, তার কোনো অসুখ বিসুখ নেই । তিনি সবসময় ফিট ! এটা কেন হয়েছে ? কারন তিনি তার কাজটা এনজয় করেন । তিনি ফ্লো খুঁজতে জানেন ।
আপনি যদি ব্যাংকে চাকরি করেন, ইন্সুরেন্স কোম্পানিতে কিংবা অন্য কোথাও কিন্তু আপনি আপনার কাজ নিয়ে খুশী না, আমি নিশ্চিত ওই কাজ আপনার মানসিক চাপ বাড়াবে । আপনি সেই কাজ ছেড়ে দিয়ে আপনার ফ্লো খুঁজুন । যে কাজে আনন্দ নেই সে কাজ চোখ বন্ধ করে ছেড়ে দিন । কী খাবেন, কি পরবেন ? বাচ্চাদের ভবিষ্যত কী হবে ? দয়াকরে এত সব ভাববেন না । স্রেফ যে কাজে আনন্দ পান ওরকম একটা কাজ খুঁজে বের করুন । হয়ত সেটা চকলেট ব্রিক্রী হতে পারে, হতে পারে গাড়ী বিক্রী, হতে পারে গান গাওয়া কিংবা অন্যকিছু …!
জীবনে প্রিয় মানুষদের সাথে প্রচুর কথা বলুন । এটা আপনাকে চাপ মুক্ত রাখবে । আর পরিমিত খাবার অভ্যাস করুন । ওই যে শুরুতে ৮০% পেট ভরে খেতে বলেছিলাম । অবশ্য এটার একটা বিকল্প আছে যেটা জাপানীরা এখন প্রেকটিস করে । ওরা সপ্তাহে দুদিন উপবাস করে । এটা অবশ্য রাসুল (সা:) এর একটা সুন্নাহও বটে । রাসুল (সা:) সপ্তাহে সোমবার এবং বৃহ:বার রোজা রাখতেন । চিন্তা করেন, দেড় হাজার বছর আগের প্রেকটিস এখন গবেষনায় স্বাস্থ্যকর প্রমাণিত হচ্ছে ।
আর অবশ্যই খাবার তালিকায় এ্যান্টি অক্সিডেন্ট যু্ক্ত খাবার রাখতে হবে যেমন গ্রিন টি/হোয়াইট টি , টুনা ফিস, গাজর, করলা, বাঁধাকপি, মিষ্টিআলু, পেয়াজ, সয়াবিন ইত্যাদি ।
সবশেষে বলি, নিজের সাথে প্রচুর কথা বলুন, পরিমিত ঘুমান, উল্টাপাল্টা ফাস্টফুড বর্জন করুন, সোডা (কোকাকোলা, পেপসি ইত্যাদি কোমল পানীয়) বর্জন করুন, জিমে যান, ফুটবল খেলুন, মোটকথা একটু ঘাম ঝরান ।
আর অতি অবশ্যই ফ্লোর সন্ধান করুন- এইসব আপনাকে ইকিগাই পেতে সাহায্য করবে । জীবনকে অর্থবহ করে তুলবে ।
বিশ্বাস করুন, এই বইটি সবার পড়া উচিত, বিশেষ করে তরুণদের । যারা বাংলায় পড়তে চান তারা এর অনুবাদটি পড়তে পারেন । ইউসুফ মুন্না বেশ সাবলিল ভাবে এর ভাষান্তর করেছেন ।
ইকিগাই ইজ এ্যা কিক ! ল্যাটস ফাইন্ড ইট !!
-তানভীর শাহরিয়ার রিমন/০৯-০৭-২১