প্রতি শুক্রবারে সকালের নাস্তা শেষে আমি আমার ফেসবুক এবং লিংকডিনের ফিল্টার ম্যাসেজ গুলো পড়ি । কিছু কিছু টেক্সট পড়ে ভালো লাগে, কিছু কিছু পড়ে বিরক্ত হই আবার কিছু কিছু পড়তে গিয়ে চোখে জল আসে ।
বিশেষ করে করোনা মহামারির পর থেকে বিগত ২/৩ মাসে যত ম্যাসেজ আমি পড়েছি তার ৮০ শতাংশ টেক্সটই হার্ট রেঞ্চিং । কেউ কেউ চাকরি হারিয়েছেন, কারো চাকরি আছে তো বেতন পাচ্ছেন না । কেউ বাসা ভাড়া দিতে পারছেন না । কারো ঘরে খারার নেই, কারো চিকিৎসার টাকা নেই …! সেই টেক্সট গুলো পড়ে আমি নিরবে অশ্রু ফেলি, নামাজে তাদের জন্য দোয়া করি ।
অনেকের প্রোফাইলে ঢুকে দেখি কয়েক মাস আগেও কত চমৎকার জীবন ছিল তাদের । পরিবার নিয়ে ঘুরেছেন । রেস্টুরেন্ট এ খেতে গেছেন, ছবি তুলেছেন । আজ কী কঠিন এক পরীক্ষায় সবাই ।
গতকাল আমার এক কাছের বন্ধু যে ইউনাইটেড ন্যাশানে কাজ করে, বলল, নিউইয়র্ক এর মতো জায়গায় বহু প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে । বহু বড় বড় সিইও বেকার হয়ে গেছেন ।
আমি সিজদায় মহান আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করি । আল্লাহ তো আমাকে ভালো রেখেছেন । সুস্থ রেখেছেন । আমাদের প্রতিষ্ঠান ভালো চলছে । আমরা কর্মীরা ঠিক আছি , সুস্থ আছি । মাসের বেতন মাসে পাচ্ছি । ঘরে খাবার আছে, চুলা জ্বলছে-রবের অনুগ্রহের তো কোনো শেষ নেই ।
কিন্তু সবাইকে নিয়ে ভালো না থাকতে পারলে সেই ভালো থাকার মাঝে কোনো আনন্দ নেই । আমরা আমাদের ক্ষুদ্র সামর্থ্য দিয়ে খুব ক্ষুদ্র পরিসরে চেষ্টা করেছি, করছি , আল্লাহ চাইলে সে চেষ্টা অব্যাহত থাকবে । তবে এই করোনা সত্যি সত্যি আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে । আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে যে আমাদের অহংকার করার মতো কিছু নেই । আমরা কতটা ক্ষুদ্র । আমরা কতটা অসহায় ।
আমাকে অনেকে বলছেন যে আমরা কি করতে পারি ?
যারা চাকরি হারিয়েছেন, যা চাকরি করছেন কিন্তু বেতন পাচ্ছেন না, যারা বাসা ভাড়া দিতে পারছেন না, বাচ্চার স্কুল ফি দিতে পারছেন না, তারা কী করতে পারেন কিংবা তাদের জন্য আমরা কী করতে পারি ?
আমার কিছু পরামর্শ আমি শেয়ার করতে চাই, যদি কারো কোনো উপকারে আসে ।
১) ইদানীং সোশ্যাল মিডিয়াতে কিছু মানুষ বলছেন যে যারা আগে সপ্তাহান্তে রেস্টুরেন্ট এ খেতে যেতেন, সেই মুহূর্তের ছবি তুলে ফেসবুকে কিংবা ইনস্টাগ্রামে শেয়ার করতেন-তাদের এই পরিণতিই স্বাভাবিক । আমি তাদের চিন্তা বিনয়ের সাথে প্রত্যাখ্যান করছি । আপনি টাকা পয়সা রোজগার কেন করেন ? শুধু বাসা ভাড়া দেবার জন্য । শুধু বাচ্চার স্কুল ফি দেবার জন্য ? শুধুই পরিবারের বরন পোষনের জন্য ? নাকী মনের আনন্দের জন্যও করেন । এখন আপনি যদি সপ্তাহে একবার পরিবার কে নিয়ে আপনার সামর্থ্যের মধ্যে কোনো রেস্টুরেন্ট এ খেতে যান তাতে আমি তো কোনো দোষ দেখিনা । যেসব দেশে রানীর কোষাঘারের টাকায় বেকারদের জীবন চলে তারাও কেমন হিমশিম খেয়েছে সে খবর নিয়েছেন ? সেখানে আমরা কী আমাদের নিজেদের নিয়ে বড্ড জাজমেন্টাল হয়ে যাচ্ছিনা ।
২) হ্যাঁ, কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমরা শো অফ করি বটে । আমরা ভাবি আমার সন্তান দামী স্কুলে না পড়লে সম্ভবত জীবনে সফল হবেনা । কাজেই যত বেশি চোস্ত ইংলিশ বলতে পারবে তত বেশি সফল হবে । হ্যা, ইংলিশ জানা অবশ্যই একটা প্লাস পয়েন্ট । কিন্তু তার মানে এই নয় যে বাংলা মিডিয়ামে পড়লে তার ইংলিশ শিখতে কোনো বাঁধা আছে । আমি তো বাংলা মিডিয়ামেই পড়া লেখা করেছি । আমার প্রথম চাকরির ইন্টারভিউ নিয়েছিলেন আইবিএর সাবেক অধ্যাপক ড. আবু ইউসুফ মুহাম্মদ আবদুল্লাহ । স্যার ইংরেজীতে টানা আধঘন্টা আমার ইন্টারভিউ করেন? সত্যি বললে গল্প করেন । তিনি জানতে চান গ্রাজুয়েশন শেষ করার আগেই কেন আমি চাকরির জন্য এপ্লাই করেছি । সেই গল্প শেষে স্যার আমাকে জিজ্ঞেস করেন যে আমার স্কুল কলেজ কোথায় । আমি যখন স্যারকে আমার বাংলা মিডিয়ামে পড়া স্কুল আর কলেজের নাম বলি স্যার চমকে উঠেন । বলেন, আমি তো ভেবেছি যে আপনি ছোট বেলা থেকে ইংলিশ মিডিয়াম পড়েছেন ।সত্যি বলতে মিডিয়াম কোনো বিষয় নয় । ইচ্ছা শক্তি একটা বড় বিষয় । কাজেই যারা এই মুহূর্তে স্কুলের ফি দিতে পারছেন না , তারা বাচ্চার স্কুল বদলাতে পারেন । কে কী বলল, এসব ভাববার দরকার নেই । তার মানে এই নয় যে আমি ভালো স্কুল এবং ভালো শিক্ষকদের ভূমিকাকে অস্বীকার করছি । অবশ্যই ভালো পরিবেশ, ভালো শিক্ষা পদ্ধতি, ভালো শিক্ষক -ভালো প্যাকেজ, আই মিন অলরাউন্ডার তৈরীতে দারুণ ভূমিকা রাখে । কিন্তু এও সত্যি গ্রামের স্কুলে পড়েও বড় বড় প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদে পৌছার অনেক উদাহরণ আছে ।
৩) যারা বাসা ভাড়া দিতে পারছেন না , তারা বাসার মালিক পক্ষের সাথে একটা সমঝোতায় যেতে পারেন যে আগামী একবছর আপনি ৩০ শতাংশ ভাড়া কম দেবেন । এটা বাড়ীর মালিক পক্ষের মেনে নেয়ার মাঝেই মঙ্গল । কারন একবার ভাড়াটিয়া চলে গেলে নতুন একজন ভাড়াটিয়া পাওয়া সহজ হবেনা । বাড়ীর মালিকদেরও কষ্ট কিছু কম নয় । তারা হয়ত ব্যাংকঋণ নিয়ে বাড়ী বানিয়েছেন । সেই ঋনের কিস্তির টাকা পরিশোধ করতে হিমশিম খাচ্ছেন । ভাড়াটিয়া চলে গেলে তো বিপদে পড়বেন। ।তাই উভয় পক্ষের সমঝোতা ছাড়া বিকল্প নেই
৪) যারা ফ্ল্যাটে থাকেন তারা ইউলিটি বিল এবং সার্ভিস চার্জ বাবদ বড় একটা টাকা দিয়ে থাকেন । এখন গরম কাল , যারা এসি ছাড়া ঘুমাতে পারেননা, একটু ফ্যানের বাতাসে ঘুমানোর অভ্যাস করুন । যেসব বিল্ডিং এ লোডশেডিং হলেই জেনারেটর চালাতেন তারা কেবল রাতের বেলায় জেনারেটর সাপোর্ট নিতে পারেন, এতে ডিজেল খরচ সাশ্রয় হবে । এখানে যদি ২ হাজার টাকা বাঁচাতে পারেন সেটা দিয়ে হয়ত বাচ্চার স্কুল ফি দিতে সুবিধা হবে ।
৫) যারা চাকরি হারিয়েছেন তারা হতাশ না হয়ে একটু ধৈর্য রাখুন । মানসিকভাবে শক্ত থাকুন । ইনশাআল্লাহ, এই কঠিন সময় বদলাবে । আপনাদের যদি জমাজাটি থাকে তো ভালো নাহলে যাদের সামর্থ্যবান আত্নীয় স্বজন আছেন তাদের কাছ থেকে সহযোগিতা নিতে পারেন । এই সময় যে বন্ধুর মতো পাশে থাকবে সেই সবচেয়ে আপনজন । আপনার সমস্যার কথা পরিবারের সদস্যদের সাথে শেয়ার করুন । আর নিজেকে প্রস্তুত রাখুন । বাসার একটি নির্দিষ্ট জায়গাকে অফিস বানিয়ে ফেলুন ।প্রতিদিন অফিসের সময়টা সেখানে বসে চাকরির খোঁজ খবর রাখুন । আপনার নেটওয়ার্কে যোগাযোগ রাখুন । নিজের কোনো দূর্বলতা থাকলে সেগুলো কাটিয়ে উঠার এটাই সেরা সময় । অনলাইনে ফ্রি অনেক কোর্স করা যায় সেসব কোর্স গুলো করতে পারেন । ইংরেজীতে দূর্বলতা থাকলে ইউটিউবে দেখে দেখে শিখতে পারেন । এই সময়ে বিদেশী অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের কাজ আউটসোর্স করবে, এবং এই চাহিদা সামনে আরো বাড়বে । তাই প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তপেশা বা ফ্রিল্যান্সিং এ যুক্ত হতে পারেন অনেকেই । আর মনে রাখবেন, আপনি যে চাকরি হারিয়েছেন এটা কেবল আপনার একার সমস্যা না । আপনার মতো অসংখ্য মানুষ চাকরি হারিয়েছেন সারা দুনিয়ায় ।
৬) সেই সাথে একটা অনুরোধ ফেসবুক মেসেঞ্জারে অপরিচিত কিংবা অল্প পরিচিত কাউকে নক করেই আপনার সমস্যার কথা বলে চাকরি খুঁজতে যাবেন না । এভাবে কেউ আপনাকে চাকরি দেবেনা । আমি আবারো বলছি, এভাবে কেউ আপনাকে চাকরি দেবেনা । আপনি যেটা করতে পারেন সেটা হলো আপনি যদি চাকরি দেয়ার মতো কারো সাথে ফেসবুকে কিংবা লিংকডিনে যুক্ত থাকেন তবে তার মেইল আইডিটি জেনে তার কাছে ইমেইলে এপয়েন্টমেন্ট চাইতে পারেন। আপনি কিসে ভালো কিভাবে ওই প্রতিষ্ঠানে ভ্যালু এড করতে পারবেন সেটা সংক্ষেপে লিখতে পারেন । তারপর অনুমতি পেলে সিভি পাঠাতে পারেন কিংবা এপয়েন্টমেন্ট নিয়ে দেখা করতে পারেন । এটাই কার্টেসি । এটাই এটিকেটস ।
৭) যারা বেতন দেয়া বন্ধ রেখেছেন তাদের প্রতি একটা অনুরোধ-ব্যবসা একা একা করা যায়না । আমাদের কর্মী লাগে । ভালো কর্মী হারালে ভবিষ্যতে ব্যবসা পরিচালনাতে সমস্যা হতে পারে । একদিনের নোটিশে চাকরি থেকে বাদ না দিয়ে কিংবা লিভ উইদআউথ পে তে না পাঠিয়ে কোলাভরেটিভ সিদ্ধান্ত নিন । এক্ষেত্রে কর্মীদের সাথে বসুন । আপনার কষ্টের কথা বলুন। কর্মীদের কথা শুনুন । দেখবেন এতদিন যারা প্রতিষ্ঠানের জন্য কাজ করেছে তারা আপনার সত্যিকার সমস্যা বুঝতে চেষ্টা করবে । ভবিষ্যত এবং অধিক মানুষের মঙ্গলের জন্য হলিস্টিক এপ্রোচে দেখতে হবে সব কিছু, দুপাশ থেকেই-এমপ্লয়ি এবং এমপ্লয়ার এন্ড থেকে । শর্টটাইম একটা প্ল্যানে যেতে পারেন, ফর নেক্সট সিক্স মানথ । আমি ধরে নিলাম আপনার প্রতিষ্ঠান আগে থেকেই পিপোল ম্যানেজমেন্ট এ অপটিমাইজড । আপনার প্রতিষ্ঠানে কোনো অতিরিক্ত এবং অপ্রয়োজনীয় লোক নাই । এবং কোনো অকর্মা নেই । অকর্মাদের জন্য কিন্তু কোনো দয়া নেই । কারন বছরের পর বছর তারা সুযোগ পেয়েও যদি তাদের স্কিল ডেভলপ না করে তবে তাদের জন্য মায়া কান্না করার কোনো প্রয়োজন নেই । তবে ভালো কর্মীদের রিটেইন করতে হবে । তাঁরাই গেম চেঞ্জার । ধরে নিলাম আপনি ৬ মাসের একটা পরিকল্পনা করে আগাতে চাইছেন সেক্ষেত্রে এরকম হতে পারে যে সাধারণ সময়ের ৩/৪ মাসের বেতন দিয়ে এইসময়ে ৬ মাস পার করবেন । এক্ষেত্রে টপডাইন মেথডে যেতে হবে । একটা বেতন রেঞ্জ ধরে উপর থেকে কমাতে হবে । যার বেতন বেশি তার কর্তনও বেশি । যার বেতন কম তার কর্তন হবে সামান্য । আরেকটা বিষয় হতে পারে শেয়ারড রিসোর্স । মনে করেন একটি গ্রুপে অনেক প্রতিষ্ঠান আছে তারা বেশ কিছু কাজ শেয়ার্ড রিসোর্স এর মাধ্যমে করতে পারে । অর্থ্যাৎ একজনের বেতন তিন চারটি SBU (strategic business unit) মিলে পরিশোধ করবে । যদি গ্রুপ অব কোম্পানিজ না হয় সেক্ষেত্রে এক্সটারনাল স্টেক হোল্ডার কিংবা কৌশলগত বিজনেস পার্টনারদের সাথে শেয়ার্ড রিসোর্স এর কথা ভাবতে পারেন । তাছাড়া প্রতিষ্ঠানের অনেক অপ্রয়োজনীয় খরচ কমিয়ে আনুন । এন্টারটেইনমেন্ট খরচ কমান । প্রমোশনাল এক্সপেন্স অপটিমাইজড করুন । কৌশলগত পার্টনারদের সাথে শেয়ারড প্রমোশনাল কনটেন্ট তৈরী করে সেগুলোর খরচও ভাগ করতে পারেন ।
৮) এবং সবশেষে আমাদের আশেপাশে যারা কষ্টে আছে তাদের কথা ভাবতে হবে । নিজে একা ভালো থাকার মাঝে আনন্দ নাই । একা খাওয়ার মাঝেও তৃপ্তি নেই । যদি এমন হয় আপনি আমার বা আমার সহকর্মীদের মতো নিয়মিত বেতন পাচ্ছেন তাহলে একটা অংশ, হতে পারে ১০ শতাংশ , মানুষের জন্য ব্যয় করুন । এই প্র্যাকটিস যদি না থাকে তবে এখন থেকে শুরু করুন । মনে রাখবেন আপনার আয়ে অন্যদেরও হক আছে ।
৯) আমি যখন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম তখন আমার বাবা মাস শেষ হবার আগেই আমাকে টাকা পাঠিয়ে দিতেন । কিন্তু আমি তখন থেকেই নানা চ্যারিটেবল কাজের সাথে যুক্ত হয়ে গিয়েছিলাম । প্রথম আলো বন্ধুসভায় ছিলাম ।লিওইজমে যু্ক্ত ছিলাম । সেই কাজে টাকা জোগাড় করার জন্য টিউশনি করতাম । মাস শেষে বাড়তি ২৫০০ টাকা পেতাম ( ২০০০-২০০২ সালের কথা বলছি ) । সেই টাকা চ্যারিটিতে ব্যয় করতাম । এখনো আমি আমার আয়ের ১০ শতাংশ চ্যারিটিতে ব্যয় করি । অন্যের জন্য করার মাঝে যে আনন্দ সে আনন্দ একধরনের নেশার মতো । একবার যারা এর স্বাদ পেয়েছে তারা আজীবন এই নেশায় বুঁদ থাকে ।