দুপুর সাড়ে বারোটায় দিকে আমি আমাদের ক্রিয়েটিভ সেকশানে মার্কেটিং ম্যানেজার মিলনের তৈরী কিছু কনটেন্ট দেখছিলাম । এরমাঝে সেল্স হেড মহি ফোন করে বলল, স্যার, সাইফুলের নাক দিয়ে অনবরত রক্ত ঝরছে । কন্ট্রোল করা যাচ্ছেনা ।
আমি ফোন কেটে দৌড়ে উপরে দশতলায় উঠে আসি । আমার পিছু পিছু মিলন, শহীদ, ইমতু, সারোয়ার, পলাশরা উপরে আসে । এর মাঝেই অন্যরা ধরাধরি করে ওকে ওয়াস রুম থেকে বের করে নিয়ে এসেছে । ফাইন্যান্স এর হানিফ ভাই, নিয়াজ, সেলসের মহি, সাব্বির, সালাউদ্দিন, রায়হান, সবাই মিলে ওকে একটা চেয়ারে বসানোর চেষ্টা করছিলেন । সাইফুল অস্থির ভাবে পা ছুঁড়তে শুরু করে । ওর অক্সিজেন সেচুরেশান মেপে দেখি ৪০ এ নিচে নেমে এসেছে । এটা খারাপ লক্ষণ ! অফিস এসিসটেন্ট শোয়েবকে বললাম, তাড়াতাড়ি অক্সিজেন সিলিন্ডার স্টোর থেকে বের করো ( গেল মাসে আমাদের সহকর্মীদের কথা ভেবে ২ টা অক্সিজেন সিলিন্ডার সার্বক্ষণিক অফিসে রাখার ব্যবস্থা করেছিলাম ) । শোয়েব এবং আশরাফ একটা অক্সিজেন সিলিন্ডার নামালে সেটা থেকে অক্সিজেন সাপোর্ট দিয়ে ওকে আমরা লিফ্টে তুললাম । উদ্দেশ্য হসপিটালে নিয়ে যাওয়া । এর মাঝে লক্ষ্য করলাম ফাইন্যান্স এর দুরদানা কান্না করছে । সে দৌড়ে এসে সম্প্রতি সাইফুলের কভিড টেস্ট এর নেগেটিভ রিপোর্টটা সাব্বিরকে দিয়ে বলল, ভাইয়া, এটা সাথে রাখেন, হসপিটালে গেলে দেখাতে হতে পারে ।
সাব্বির রিপোর্টটা হাতে নিল । আমরা ধরাধরি করে লিফ্টে করে নামিয়ে ওকে প্রথমে আমাদের পাশের বিল্ডিং এর ইসলামি ব্যাংক হসপিটালে নিয়ে গেলাম । সেখানে কোনো সিসিইউ সাপোর্ট না থাকায় আগ্রাবাদস্থ মা ও শিশু হসপিটালের এক কাছের বড় ভাই ডা: সাইফউদ্দিন সুজাকে ফোন করি । তিনি বলেন, আপনারা ইমার্জেন্সিতে নিয়ে যান, ওখানে ডাক্তার শান্তনুকে বলে দিচ্ছি, সে সিসিইউতে সিট ব্যবস্থা করে দেবে ।
এর মাঝে ওর পরিবারকে খবর দেয়া হয় । তার ছোট ভাই ছুটে আসেন । তিনি একটা ইনজেকশান (যেটা তাকে নিয়মিত নিতে হয় ) নিয়ে এসে পানিতে মিশিয়ে খাওয়াতে চেষ্টা করেন ।
আমরা এর মাঝে এম্বুলেন্স না পেয়ে অফিসের গাড়িতে করেই সাইফুলকে নিয়ে মা ও শিশু হসপিটালে যাই । আমি, হানিফ ভাই আর মহি ওখানে পৌছে দেখি সাইফুলের বোন, দুলাভাই পৌছে গেছেন । কিছুক্ষন পর তার স্ত্রী ৪/৫ বছর বয়সি একমাত্র ছেলে নেহালকে নিয়ে ছুটে আসেন । নেহাল কান্নাকাটি করে বলতে থাকে, আব্বুর কাছে যাব…! সে এক আবেগঘন দৃশ্য ! অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে তাদেরকে বাসায় পাঠান হানিফ ভাই ।
ডাক্তার শান্তনু খুব দ্রুত সিসিইউতে স্থানান্তর করে দেন সাইফুলকে । মহিকে বলি অফিসে চলে যেতে । আমি আর হানিফ ভাই রয়ে যাই । আমরা আড়াইটার দিকে অফিসে আসি । ফিরে দেখি পুরো অফিস সাইফুলের চিন্তায় ভেঙে পড়ছে ।
আমি যখন এই প্রতিষ্ঠানে যোগ দিই তখন এরকম একটা পরিবারের স্বপ্ন দেখেছিলাম যেখানে পেশাগত সম্পর্ক ছাপিয়ে একেকজন সহকর্মী হয়ে উঠবে নিতান্তই আপনজন । দুরদানার চোখের জল, হানিফ ভাই, নিয়াজ, ইমতিয়াজ সহ সেল্স বিভাগের মহি, সাব্বির, সালাহ, রায়হান, সুমন, আবির এর অস্থির ছুটাছুটি, সাপ্লাই চেইন, ইন্জিনিয়ারিং, এডমিন, এইচআর, বিজনেস ডেভলপমেন্ট, মার্কেটিং, ডিজাইন সহ অন্যান্য বিভাগের লোকজনের এমপ্যাথিক আচরণ প্রমাণ করেছে আমরা আসলেই একটা পরিবার । মানবিক পরিবার !
সাইফুল সেই পরিবারের একজন কন্ট্রিবিউটিং মেম্বার । এত হাসিখুশি চেহারা যে বুঝার উপায় নেই মাত্র দশবছর বয়সে হার্টে বড় ধরনের একটা বাইপাস করিয়েছে সে । প্রায়ই ভেতরে জমাট বেধে যাওয়া রক্ত ফেলতে হতো তাকে । কিন্তু দেখলে কখনো বোঝা যেতনা ভেতরে তার কী ক্ষরণ ! বর্তমান কভিড পরিস্থিতিতে ঈদের আগে প্রায়ই পিপিই পরে অফিসে আসত । একদিন হাসতে হাসতে বলেছিলাম কী সাইফুল, সম্মুখ সমরের প্রস্তুতি নিচ্ছেন নাকী ?
-না স্যার, আমি তো খুব ভলনারেবল, তাই সাবধানে থাকি ।সাবধানে থাকা সাইফুল কভিড টেস্ট এ পাশ মার্ক পেয়ে অফিসে যোগ দেয় গেল সপ্তাহে । নিয়মিত অফিস করছিল তার স্বভাব সুলভ হাসিমুখ নিয়ে । আমরা কী তার সেই হাসিমাখা, মায়াভরা মুখ আর দেখবনা ?
কিছুক্ষণ আগে সাইফুলের বড় ভাই ফোন দিয়ে জানালেন, ওর অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি । বরং আমি যে অন্য একটা বেসরকারী হাসপাতালে ওর জন্য একটা আইসিইউ বেড বুক করে রেখেছিলাম, উনি বললেন ওটার এই মুহূর্তে প্রয়োজন ফুরিয়েছে । আইসিইউ কোনো উপকারে আসবেনা ওর । উনি দোয়া চাইলেন । বললেন, দোয়াই একমাত্র সহায় ।
সবার কাছে একটু দোয়া চাই । আমার প্রিয় সহকর্মী যেন আবার ফিরে আসে আমাদের মাঝে ! ওর ছোট্ট নেহাল যেন আবার বাবার বুকে স্নেহের উষ্ণতা খুঁজতে পারে ।
হে আল্লাহ একমাত্র তুমি সহায়…
2/7/20