সকালে ঘুম থেকে উঠে নাস্তার টেবিলে বসে ফেসবুকে স্ক্রল করছিলাম । এর মাঝে সিটিজি ব্লাড ব্যাংকে একটা পোস্টে চোখ পড়ল-একজন ৬ বছর বয়সি থ্যালাসেমিয়া রোগীর জন্য AB+ ব্লাড দরকার ।
আমি নাস্তা শেষ করে ফ্যামিলি লিভিং এর কাউচে একটু আরাম করে বসে হিসাব কষে দেখলাম আমার সর্বশেষ ব্লাড ডোনেশনের ৪ মাস হয়ে গেছে । তাই সাথে সাথে ওই নাম্বারে ফোন দিলাম ।
-আসসালামুআলাইকুম ভাই , ফেসবুকে দেখলাম একটা বাচ্চার জন্য ব্লাড দরকার । আমি একজন ডোনার । কখন লাগবে রক্ত ?
-ভাই লাগবে দুপুর ৩টার দিকে । আমরা সন্দিপ থেকে আসতেছি ।আপাতত একজন ডোনারের ব্যবস্থা হয়েছে, কোনো কারনে উনি না এলে আপনাকে জানাব । ওপাশ থেকে জানালেন রোগীর মামা ।
-আচ্ছা ভাই, যদি প্রয়োজন পড়ে তবে ঘন্টা খানেক আগে আমাকে জানাবেন ।
ঠিক আছে বলে তিনি ফোন রেখে দিলেন ।
ঘড়িতে তিনটা পার হওয়ায় ধরে নিই ওই ডোনার ব্লাড দিয়েছেন, নিশ্চয়ই আর রক্ত লাগবেনা । আমি লাঞ্চ শেষে “কেইথ ফেরাজ্জীর” “নেভার ইট এলোন” বইটি পড়তে বসি । ততক্ষণে প্রায় ১০ পৃষ্টা পড়া হয়ে গেছে । ঘড়িতে প্রায় সোয়া চারটা বাজে। এমন সময় সেই নাম্বার থেকে ফোন আসল ।
-ভাই, ডোনার তো বেকে বসছে । আমরা প্রায় ১ ঘন্টা ধরে অপেক্ষা করছি আন্দরকিল্লা রেড় ক্রিসেন্ট ব্লাড সেন্টারে ।
-বেকে বসেছেন মানে ?
-ভাই, উনার ফ্যামিলি নাকী রাজী হচ্ছেনা, করোনার সময় উনাকে বাইরে গিয়ে রক্ত দিতে । এখন মোবাইল ও বন্ধ করে ফেলেছেন । আপনি কী আসতে পারবেন ?
আমি বইটি বুক সেল্ফে রেখে বললাম, ভাই, আসরের নামাজটা পড়েই বের হচ্ছি । আপনি চিন্তা করবেননা ।
নামাজ পড়েই আমার স্ত্রীকে বললাম-আমাকে একটু আন্দরকিল্লা যেতে হবে ব্লাড দিতে ।
সে ব্রু কুচকে বলল, এই সময়ে ? বাদ দাও !
-তুমি ! তুমি একথা বলছ ? তোমার মতো মানবিক মানুষ একথা বলছে ?
-দেখো, ওখানে তো করোনা হাসপাতাল আছে ।
-তো ? আশেপাশে লোকজন কী সবাই এলাকা ছেড়ে দিয়েছে ?
-না, আসলে তোমাকে এই মুহূর্তে চোখের সামনে থেকে সরাতে ইচ্ছে করছেনা ।
-দেখো গেল সপ্তাহে তোমার দূরসম্পর্কের আত্নীয়ের জন্য যখন ৩ ব্যাগ O+ ব্লাড লাগছিল তখন তো তুমি আমাকে ম্যানেজ করতে বললে ! আমি ফেসবুকে পোস্ট করার দশ মিনিটের মাঝে ব্লাড ম্যানেজ হয়ে গেল । রোগী বাঁচল ! তাইনা ? তখন কী ওই ডোনারদের কথা ভেবেছিলে ?
আমার স্ত্রী এবার একটু ইতস্ত করে বলল, হ্যাঁ, ঠিক আছে যাও । তবে একটু সেফটি নিয়ে যাও । বলেই সে নিজেই আমাকে হ্যান্ড গ্লাবস, মোটা মাস্ক এবং চশমা পরিয়ে দিল ।
আমি রেডক্রিসেন্ট ব্লাড ব্যাংকে পৌছে দেখলাম ওদের সেবা বন্ধ হয়ে গেছে । রোগীর মামা গেটে দাঁড়িয়ে আছেন অসহায়ের মতো । ডাক্তারে সাথে ফোনে কথা বলছিলেন । ডাক্তার বললেন চিটাগাং মেডিক্যাল ব্লাড ব্যাংকে যেতে ।
উনাকে আমার গাড়িতে তুলে আমরা চিটাগাং মেডিক্যাল এর ব্লাড ব্যাংকে আসলাম ।
রক্ত দেয়া শেষ হলে উনাকে বললাম, মন বড় রাখেন ভাই । রক্তের প্রয়োজন হলে আমাকে জানাবেন, আমাদের সিটিজি ব্লাড ব্যাংকে অনেক সাহসী ডোনার আছেন । তারা সংকটে, বিপদে মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা করেন ।
উনি আমাকে থ্যাংকস জানিয়ে একটা রিস্কা ডেকে ছুটলেন দেওয়ানবাজার থ্যালাসেমিয়া সেন্টারের দিকে । সেখানে তার বোন এবং ভাগ্নে পথ চেয়ে আছে তার জন্য ।
আমি মন ভর্তি সুখ নিয়ে বাসায় ফিরে সোজা ঢুকলাম শাওয়ারে । নিজেকে পরিপূর্ণ স্যানিটাইজ করে বের হয়ে দেখলাম আমার স্ত্রী মাল্টার জুস বানিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ।
আমাকে জুসের গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে বলল, ঝটপট খেয়ে নাও হিরো !