করোনা উদ্ভুত পরিস্থিতিতে তখনো পুরোপুরি হোম অফিস (বাসায় বসে অফিস) শুরু হয়নি আমাদের । অলটারনেটিভ ওয়ার্ক ডে চলছিল তখন । ৫০ শতাংশ কর্মী ঘরে বসে কাজ করছিল যেদিন ৫০ শতাংশ কাজ করছিল অফিসে বসে ।
তেমনি একদিনে একটা ছোট মিটিংয়ের মাঝে লক্ষ্য করলাম আমার সহকর্মী হায়দারের নাক দিয়ে টপ টপ করে রক্ত ঝরছে । আমি আতংকিত হয়ে পড়লাম । হায়দারকে আরো কয়েকজন মিলে ফ্রেশ রুমে নিয়ে গেলাম । কিছুক্ষনের মাঝেই ওর রক্ত পড়া বন্ধ হলো ।
আমি ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেলাম । মনের মাঝে একটা কু-ডাক দিচ্ছে তখন । আমি হায়দারের টিম লিডারকে ডেকে বললাম
-ওকে একটা ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাও, বস ।
-স্যার, এটা তো প্রথম না ! এরকম আরো একবার ওর রক্ত বের হইছে !
-বলো কী ! আমাকে জানাওনি কেন ?
-স্যার, ভাবছি এটা হয়ত কোনো আঘাত থেকে হইছে । সিরিয়াস কিছুনা । তারপরও আমি হায়দারকে ডাক্তারের কাছে নিতে চাইছি, সে যায়নি ।
এবার কপট রাগ করে হায়দারকে কাছে ডাকলাম, কী ব্যাপার, নিজের স্বাস্থ্য নিয়ে এত উদাসীন কেন ?
-স্যার আসলে কাজের ব্যস্ততায় যাব যাব করে আর যাইনি ।
-তাহলে এখন যাও । আমার পরিচিত ডাক্তার আছেন ।এপয়েন্টমেন্ট করিয়ে দিচ্ছি ।
-না স্যার, এখন না । বরং পারলে আমাকে পাঁচদিনের ছুটি দেন স্যার । একটু বাড়ী যাব । মেয়েটা অসুস্থ । ওকে ডাক্তার দেখাতে হবে ।
আমি লক্ষ্য করলাম হায়দারের চোখ টলমল করছে । যেকোনো মুহূর্তে ওর চোখ বেয়ে প্লাবন নামবে । আমি ওর কাঁধে হাত রাখতেই ও হাউ মাউ করে কেঁদে ফেলল ।
-স্যার, আমি বাঁচতে চাই স্যার । জীবনে বহু বছর বাঁচতে চাই । আমার মেয়েটার জন্য । এতটুকুন প্রাণে আমাকে বাবা, বাবা বলে ডাকে…আমার কিছু হলে…!
আমি হায়দারের পিঠে মৃদু থাপ্পর দিয়ে বলি, পাগল, এরকম রক্ত নাক দিয়ে টুকটাক অনেকেরই পড়ে । এটাকে বলে এপিসট্যাক্সিস । নাকের ঝিল্লি শুকিয়ে গেলে, ফেটে গেলে বা সেখানে শক্ত আবরণ সৃষ্টি হলে স্বাভাবিকভাবেই নাক থেকে রক্তপাত হতে পারে। তুমি ভয় পেওনা । আমি নিজে তোমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব ।
নিজেকে সামলে হায়দার বলে, স্যার, আমি আগে একটু বাড়ী যেতে চাই । মেয়েটাকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে । আগে স্যার জীবনের প্রতি অতোটা মায়া অনুভব করতাম না । কিন্তু বিয়ের পর, বিশেষ করে মেয়েটা হবার পর খুব বাঁচতে ইচ্ছে করে ।
আমি হায়দারকে কাছে টেনে নিয়ে বলি, তোমার পাঁচদিন না, যে কদিন ছুটি লাগে তুমি নাও । জীবনে পরিবারের চেয়ে বড় কিছু নেই । মানুষ নিজের জন্য বাঁচেনা ,প্রিয়জনদের জন্যই বাঁচে…।
হায়দারকে ছুটি থেকে ফিরতে হয়নি । ততদিনে আমাদের হোম অফিস চালু হয়ে গেছে ।
হায়দার আজ সকালে ফোন দিল
-স্যার,সেদিন যখন রক্ত পড়ছিল কী যে ভয় পেয়েছিলাম ! আপনাকে ধন্যবাদ স্যার আমাকে সাহস দেয়ার জন্য ।
-আর কী রক্ত পড়েছে ?
-না, স্যার । করোনার নাম শোনার পর থেকে নাক দিয়ে রক্ত না, সর্দি পড়ছে কিনা সেদিকে খেয়াল করছি । মনে হচ্ছে, রক্ত পড়লেও বেঁচে থাকব । কিন্তু সর্দি পড়লে তো মনে হয় নিস্তার নাই ।
-কী যে বলো হায়দার ! করোনা তোমাকে ধরবেনা । তুমি তো জীবনের পক্ষের লোক । প্রিয়জনদের জন্য বাঁচতে চাও তুমি ।
–জি স্যার , দুনিয়াটা আসলে মায়ার কারনেই এতো সুন্দর।
-তা তোমার মেয়ে কেমন আছে ?
-ভালো আছে স্যার । ফিঁক করে হাসি দেয় । খুব সুন্দর লাগে দেখতে ।
আমাদের সন্তানরা এরকম ফিক করে হাসতে থাকুক । পৃথিবীটা তাদের জন্য নিরাপদ থাকুক ।
-তানভীর শাহরিয়ার রিমন