তখন আমি ক্লাস এইট কিংবা নাইনে পড়ি । আম্মা হঠাৎ বাসায় একটা রুল জারি করলেন । জুতা ব্যবহারের রুল । বাসার বাইরে যাবার জন্য আলাদা জুতা, বাসায় পরার জন্য আলাদা এবং টয়লেটে যাবার জন্য আলাদা । আম্মা নির্দিষ্ট স্থানে জুতা রাখার ব্যবস্থা করলেন । প্রথমে ভীষণ অস্বস্থি লাগত । মাঝে মাঝে বাইরের জুতা পায়ে ভুল করে বাসার ভেতরে ঢুকে যেতাম । সাথে সাথে আম্মা দৌঁড়ে আসতেন । সাবধান করতেন । এটা ধীরে ধীরে অভ্যাসে পরিণত হলো আমাদের ।
স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কলেজে গেলাম । এবার আম্মা নতুন নিয়ম বানালেন । বাসার কাপড় এবং বাইরের কাপড় আলাদা থাকতে হবে । যে কাপড় পরে আমরা ঘরের বাইরে যেতাম সেটা বাসায় আসার সাথে সাথেই বদলে ফেলতে হবে । কোনো অবস্থাতেই ওই কাপড় গায়ে দিয়ে নির্দিষ্ট একটি কক্ষ ছাড়া অন্য কক্ষে যাওয়া যাবেনা । আমরা সেই রুটিন ইচ্ছের বিরুদ্ধেও অনুসরন করতে লাগলাম । আমরা মানে আমি, আব্বা আর আমার ছোট ভাই তানজীব ।
শুধু এতটুকু হলে মনে হয় হতো । আম্মা এরপর আরো কঠিন এক নিয়ম তৈরী করলেন । বাসায় কোনো মেহমান আসলে তারা যেন বসার ঘর থেকে অন্য কোনো ঘরে না যায় । কারন তারা তো বাইরের কাপড় পরে আছে । যে কাপড়ে আম্মার ভাষায় নানা রকম রোগ জীবানু লেগে আছে । এখন দেখা গেলো অনেক আত্নীয় স্বজনকে না হয় ব্যাপারটা বলা যায় যে আম্মার শুচি বাই হয়েছে , কিন্তু বন্ধু বান্ধবদের কী করে বলি ? আমি আব্বা, এবং তানজীব গোপনে বৈঠক করি । আম্মা যেন শুনতে না পান । কারন আম্মা যদি জানতে পারেন যে আমরা ব্যাপারটা সহজভাবে নিচ্ছিনা তাহলে হয়ত তিনি কষ্ট পাবেন । রাগারাগি করবেন । ততদিনে বন্ধু মহলও বিষয়টা জেনে গেল ।
কিছুদিন পর দেখলাম এই শুচিবাই আরো বাড়তে লাগল । আমরা বাইরে থেকে এসে হাত না ধুয়ে কোনো কিছু ধরতে পারতাম না । এমনকি একটা লাইটের সুইচ পর্যন্ত টীপতে আম্মা নিষেধ করে দিলেন ।
তখন খুব বিরক্ত লাগত । মনে হতো এটা আম্মার কোনো মানসিক রোগ । বাসার ফ্লোরে কোনো কিছু পড়লে সেটা যদি একটি কলমও হয় তবু না ধুয়ে ব্যবহার করতে দিতেননা আম্মা । বহুবার এরকম হয়েছে , পড়ার টেবিল থেকে কলম ফ্লোরে পড়ে গেছে, আম্মা শব্দ পেয়ে দৌড়ে এসেছেন, জিজ্ঞেস করছেন -কী পড়ছেরে ?
-না, আম্মা কিছুনা, চেয়ার নড়ার শব্দ করছে আম্মা !
আম্মা কান মলা দিয়ে ঠিকই কলমটা নিয়ে গিয়ে ধুয়ে এনে দিতেন ।
বাসায় পেপার রাখতেন আব্বা । সেই পেপার ফ্লোরে ফেলে দিয়ে চলে যেত হকার । আম্মা সেই পেপারটি শুকনা কাপড় দিয়ে তিন-চারবার পরিস্কার করে তারপর পড়তে দিতেন আমাদের । দু’একবার ভুলে ফ্লোর থেকে তুলে পড়তে শুরু করেছি, দেখি সামনে আম্মা দাঁড়িয়ে । তারপর যথারীতি কানমলা…!
তার অনেক বছর পরের ঘটনা । তখন আমি বিয়ে করে সংসার পেতেছি । আম্মা সিলেট থেকে চিটাগাং বেড়াতে আসতেন । আম্মা আসলে পুরা বাসা চকচক করত । আমি এবং আমার স্ত্রী সচেতন ভাবে চাইতাম ঘরটা পাক পবিত্র থাকুক । ডেটল ওয়াশ করে রাখতাম আমরা ।
যখন আমাদের সন্তান হলো । তারপর কী করে যেন এক আমুল বদল এলো আম্মার মাঝে । নিয়ম কানুন শীতিল হতে থাকল । আমরা সিলেটে বেড়াতে গেলে আম্মার নাতী সারা ঘর ঘুরে বেড়াত । আম্মার বিছানায় উঠে যেত । আম্মা কিচ্ছু বলতেন না ।
আমরা ৫/৭ দিন থেকে মহাআনন্দে চিটাগাং ফিরে এসে আব্বাকে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করতাম, আম্মার শুচি বাই কেমনে বদলে গেল !
-আব্বা হাসতে হাসতে বলতেন, “ওটা বদলায়নিরে বাপ, বদলায়নি । নাতীর জন্য শুধু স্পেশাল ছাড় দেয়া হয়েছে ।তোমরা যাবার পর আবার পুরা ঘর পরিস্কার করা হয়েছে । তোমার মা নিজের হাতে পরিস্কার করছেন ।”
আম্মা যতদিন বেঁচে ছিলেন, আমরা আর কখনো আম্মার শুচিবাই টের পাইনি । না সিলেটে , না চট্টগ্রামে । প্রথমে নাতী তারপর নাতীন । ওদের উপস্থিতি কিছুদিনের জন্য আম্মার সংস্কার , আম্মার বিশ্বাসে একটা সাময়িক বিরতী টেনে দিত ।
২০১৩ এ আম্মার ক্যান্সার ধরা পড়লে আমরা আম্মাকে আর সিলেট যেতে দিতাম না । আম্মা আর আব্বা চট্টগ্রামে বসবাস করা শুরু করলেন । ভীষণ স্মার্ট ছিলেন আম্মা । সময়ের আগে চিন্তা করতে পারার দারুণ ক্ষমতা ছিল তাঁর । জীবনে বেঁচে থাকতে তিনি যে অভ্যাস গুলো আমাদের করিয়েছিলেন সে অভ্যাসগুলো এখন আমাদের কাজে লাগছে । আমাদের কাছে মনে হচ্ছে, আম্মার শুচিবাই ছিলনা । আম্মা সময়ের বহু আগে আমাদের ট্রেনিং দিয়ে গেছেন-কী করে সংক্রামক মহামারি করোনা ভাইরাস থেকে দূরে থাকতে হবে ।
বেঁচে থাকলে আম্মা আজ হাসতেন । বলতেন , কী রে , তোরা তো মনে মনে তখন আমাকে মানসিক রোগী ভাবতি ! পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা যেমন ইমানের অঙ্গ ঠীক তেমনি সংক্রামক রোগ প্রতিরোধকও ।
আম্মা নেই । আম্মার তৈরী করে দেয়া অভ্যাস আছে । রাব্বীর হাম হুমা কামা রাব্বাইয়ানি সাগিরা ।