বোর্ড মিটিং শেষে এয়ারপোর্টে পৌছাতে পৌছাতে রাত আটটা
বেজে যায় । চিটাগাং ফিরব রাত ৯টার ফ্লাইটে । এমন সময় আব্বার ফোন আসল
-তুমি কী চিটাগাং পৌঁছাইছ ?
-না, আব্বা, আমার ফ্লাইট তো নয়টায় !
-ওহ, তাইলে তো তোমার আসতে দেরী হইব !
-জি আব্বা, বাসায় পৌছতে পৌছতে ১১টা বাজবে ।
আব্বার গলার স্বরটা আমার কাছে কেমন জানি লাগল । আব্বা কী অসুস্থ ? বুধবার সকালে বাসা থেকে বের হবার সময় তো আব্বা সুস্থ ছিলেন ।
ফ্লাইটে উঠেছি এমন সময় আমার স্ত্রীর ফোন এলো,
-এ্যাই তুমি কী ফ্লাইটে ?
-হ্যা, কেন ?
-শোনো, ফ্লাইট থেকে নেমে তাড়াতাড়ি ফোন দিবা !
আমার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করলো । বাসায় কী কোনো ঝামেলা হয়েছে ?
বিমানে আমি বসেছি একদম সামনের সিটের আইলে । প্রায় ৫৫ বছর বয়সি একজন ভদ্র মহিলা আসলেন উইন্ডো সিটে বসার জন্য । হ্যান্ড ব্যাগটি কেবিনে রাখতে গিয়ে আমার মাথার উপর ফেলে দিলেন !
আমি কোনো রকম নিজেকে সামলে উনার দিকে তাকালাম । ভদ্র মহিলা লজ্জিত ভঙ্গিতে বললেন, সরি বাবা, হাত পিছলে…
-নো ওরিস ম্যাডাম ! আমি তেমন ব্যথা পাইনি । উনাকে লজ্জা থেকে বাঁচাতে এটুকু আমাকে বলতেই হলো ।
আধঘন্টা চল্লিশ মিনিটের আকাশ পথ আমার কাছে দীর্ঘ মনে হতে লাগল । বাসায় কী হয়েছে ? আব্বা ফোন করলেন, আবার আমার স্ত্রীও…
বিমান থেকে নেমে দ্রুত গাড়িতে উঠেই স্ত্রীকে ফোন দিলাম ।
-কী জন্য ফোন দিতে বলেছ ? কোনো সমস্যা ?
-শোনো, বাবা তো কোয়ারেন্টাইনে (অন্যদের থেকে আলাদা থাকা) চলে গেছেন মনে হয় । আমাকে, তেহজীব-আলভীরাকে এমনকি রুমি এবং জায়েদাকে কাছে ঘেষতে দিচ্ছেন না ।
-বলো কী ? কখন থেকে ?
-এই তো সন্ধ্যার পর থেকে । সর্দিটা বাড়ছে । নাক লাল হয়ে আছে । তবে জ্বর নাই । তুমি তাড়াতাড়ি আসো …।
আমি বাসায় পৌছে আব্বার কাছে গেলাম ।
আব্বা আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার বোর্ড মিটিং কেমন হইছে ?
-ভালো হইছে আব্বা । তা আপনি নাকী কাউকে কাছে ঘেষতে দিচ্ছেন না !
-হ্যা, সর্দি তো কমতেছেনা । বলা তো যায়না, ক…
আমি আব্বার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললাম, আব্বা, আপনার এই সর্দি তো প্রতিবছর একবার হয় । আপনাকে ৪/৫ দিন কষ্ট দেয় । তারপর চলে যায় ।
-না, এবার তো চারদিকে খারাপ বাতাস । পত্রিকায় কত কিছু পড়ি …!
এমন সময় আমার স্ত্রী আসল
-বাবা পেপারে দেখছে-ওবামা, ট্রাম্প রোনাল্ডো সহ বহু মানুষ কোয়ারেন্টাইনে গেছে । তাই মনে হয়…
আমি আব্বার দিকে তাকিয়ে বলি , যাক, ওরা যাক ।সারা পৃথিবী যাক, আপনারে যাইতে হবেনা । মন বড় রাখেন আব্বা । আপনারে করোনা ধরতে পারবনা ।
আমি জায়েদাকে বললাম ফার্মাসী থেকে এলাট্রোল নিয়ে আসতে ।
আব্বা পাশ থেকে বললেন, না না , লাগবেনা, আমি তো হিসটাছিন খাচ্ছি ।
-আব্বা, মাঝে মাঝে একই ওষুধ বারবার খেলে কাজ করেনা । আমি জানি সর্দি হলে আপনি হিসটাছিন খান । তাই এবার এলাট্রোল আনতে বলছি ।
আব্বা বলেন, পেপারে পড়ছি চীন, কোরিয়া, ইতালিতে লোকজন জীবন বাঁচাতে আক্রান্ত আপনজনদের আলাদা করে দিচ্ছে । কোথায় কোথাও নাকী মেরেও ফেলছে…
আব্বা, আমরা চাইনিজ-কোরিয়ান না । আমরা যত বড় বিপদই হোক আপনজনদের হাত ছাড়িনা । আপনার কাছ থেকে, আম্মার কাছ থেকেই তো শিখছি এগুলা ।
আমরা সতর্ক থাকব । সাবধান থাকব । তারপরও যদি করোনা চলে আসে-দেখে নিব ব্যাটারে …!
জায়েদা ততক্ষনে এলাট্রোল নিয়ে চলে আসছে । আমি পানি আর একটা টেবলেট আব্বার হাতে দিয়ে বললাম, খেয়ে নেন আব্বা, সকাল বেলা দেখবেন-সর্দি গায়ের ।
এমন সময় আমার মেয়ে দৌড়ে এসে আব্বার কোলে উঠে গেল । আব্বা এবার আর বাঁধা দিলেন না । বরং চিকচিক করা চোখ থেকে চশমাটা খুলে একটু মুচকি হাসলেন । আমার ছেলে চান্সটা আর মিস করতে চাইলনা, সেও আব্বাকে জড়িয়ে ধরল ।
আমি আব্বার রুমের লাইট নিবিয়ে জানালার পর্দা টেনে দিতে গিয়ে দেখলাম কী পরিস্কার ঝলমলে আকাশ । মনে হলো আম্মা সেখানে বসে মুচকি মুচকি হাসছেন