বাবার ছিল বদলির চাকরি । সেই সুবাদে তখন আমরা ব্রাক্ষনবাড়ীয়ার বাসিন্দা । ক্লাস ফাইভে পড়ি ।বয়স এই ১০ বছর । আমরা একটা সরকারী বাংলোতে থাকতাম । বাংলোতে যাবার পথের পাশে ছিল বিরাট এক দিঘী । লোক মুখে এই দিঘী নিয়ে নানা কল্প কাহিনী শুনতাম । মাঝে মাঝে কুন্ডলীর মতো পাকিয়ে উঠত মাঝ দীঘির জল । আমরা তখন আতংকে দিঘী থেকে শত হাত দূরে সরে যেতাম । কেউ কেউ বলত, এই দিঘীতে কোনো দৈত্য বাস করে । আমাদের শিশু মন তখন তাই বিশ্বাস করত…!
বাংলো থেকে আধ কিলোমিটার দূরে ছিল প্রাইমারী স্কুল । আমি আর আমার ছোট ভাই হেঁটে হেঁটেই স্কুলে যেতাম । আমার চেয়ে পাঁচ বছরের ছোট আমার অনুজ, পড়ত ক্লাস ওয়ানে ।আমার ক্লাসে বয়সের দিকে সবচেয়ে ছোট ছিলাম আমি । দেখতে শুনতেও । আমার সাথে পড়ত মোর্শেদ নামে এক ছেলে । বয়সে সে ছিল ২/৩ বছরে বড় আর দেখতেও লম্বা । একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে সেই দিঘীর সামনে আসতেই আমাদের মধ্যে লেগে যায় তুমুল ঝগড়া । সেই ঝগড়া রীতিমতো হাতাহাতিতে রুপ নেয় । আমি কোনোভাবেই পেরে উঠছিলামনা আমার চেয়ে বড় আর শক্ত সামর্থ্য মোর্শেদ এর সাথে । একপর্যায়ে আত্নরক্ষার্থে আমি ওকে ঢিল ছুড়তে শুরু করি । সেও পাল্টা আমাকে ঢিল ছুড়তে থাকে । এভাবে প্রায় ১০ মিনিট পাল্টাপাল্টি ঢিল যুদ্ধ চলতে থাকে । হঠাৎ করে আমি লক্ষ্য করলাম, আমি যখন ঢিল একটা ছুড়ছি সেই ঢিল দুটো হয়ে মোর্শেদ এর দিকে যাচ্ছে । আমি অবাক হয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখলাম আমার ছোট ভাই ঢিল ছুড়তে ছুড়তে এগিয়ে আসছে । পাঁচ বছরের পুঁচকে ভাইকে দেখে আমার শক্তি এবং মনোবল আরো বেড়ে গেল । দুভাইয়ের যুগল আক্রমণের তীব্রতায় মোর্শেদ পিছু হটতে শুরু করলো । এবং একসময় দৌঁড়ে সে পালিয়ে গেল ।
সেই থেকে বহুবার এমন করেই আমার এই ভাইটি কঠিন সময়ে আমার পাশে থেকেছে । সাহস যুগিয়েছে । ঠেস হয়েছে ।
গত শুক্রবার রাতে যখন সে এক মাসের ছুটি কাটিয়ে লন্ডন ফিরে যাচ্ছিল, তাকে বিদায় জানাতে বুকে জড়িয়ে ধরলাম । বিশ্বাস করুন তখন খুব অসহায় বোধ করছিলাম ।
মাঝে মাঝে এই বয়সেও কখনো কখনো মনে হয় কোনো নির্জন দীঘির পাশ দিয়ে হেটে যাচ্ছি । সেই দীঘির মাঝ বরাবর কুন্ডলী পাকিয়ে পানি ঘুরছে । মনে হয় এই দীঘি বড় অপয়া, এখানে কোনো বিপদ আছে-ওঁত পেতে আছে কোনো দৈত্যের দল । তবু আমি ভয়ে কুকড়ে যাইনা । আমি জানি, যত যাই কিছু হোক, যত বিপদই হোক, প্রয়োজন
মুহূর্তে পেছন থেকে ঠিকই দৌঁড়ে আসবে আমার ভাই -আমার ছোট ভাই ।